মওলানা ভাসানীর “লাকুম দীনুকুম ওলিয়াদিন” ঘোষণা
।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া ।।
অনলাইন ডেস্ক- মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আজন্ম স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। বাংলাদেশ-বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস তাকে ছাড়া পূর্ণ হয় না। যদিও দীর্ঘ সময় ধরে শাসকগোষ্টির অবহেলার স্বীকার এই মহান নেতার স্থান ইতিহাসের অবহেলিত জায়গায়। বিভিন্ন সময় শাসকগোষ্টি তাদের প্রয়োজনে মওলানা ভাসানীর নামটি ব্যবহার করলেও তাকে জানাননি যথাযথ সম্মান। মওলানা ভাসানী নিজের সম্ভ্রান্ত আর রক্ষণশীল পরিবারের বাধা ভেঙে সমাজের সাধারণ-মেহনতি মানুষের কাতারে চলে আসেন। অত্যাচারিত, দারিদ্রপীড়িত, খেটে খাওয়া মেহনতি মজলুম মানুষের জন্য হয়ে ওঠেন একান্ত নিবেদিত প্রাণ।
মওলানা ভাসানী বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার ভিত্তিতেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন বাঙালি জাতিস্বত্ত্বার অনুকূলে পৃথক একটি আবাসভূমি গড়ার। আর এই কারণেই পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের মানুষের মনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের বিজ বপিত করতে পেরেছিলেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ তথা আওয়ামী লীগ গঠন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলন, প্রখ্যাত উক্তি 'আসসালামু আলাইকুম' উচ্চারন, ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাপ গঠন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে 'স্বাধীন পূর্ব বাংলার ঘোষনা'সহ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
১৯৪৮ সালেই পূর্ববাংলা আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে পরিষদ অধিবেশনে তিনি বাংলায় কথা বলার দাবি উত্থাপন করেন। ১৯ মার্চ বাজেট অধিবেশনের আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ‘আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম?’ মূলতঃ পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই ভাষা, শাসনতন্ত্র প্রণয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায় পশ্চিমা শিবিরে। শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য আর শোষণের গভীর ষড়যন্ত্র।
এহেন পরিস্থিতিতে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকেলে ঢাকার টিকাটুলির রোজগার্ডেনে মুসলিম লীগ কর্মীদের বিদ্রোহী গ্রুপের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত প্রায় শ’তিনেক প্রতিনিধির সম্মতিতে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। চল্লিশ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ।
এভাবেই রাজনীতির এক চমন দু:সময়ে ১৯৬৯ সালের ২ জানুয়ারি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে পাঁচবিবিতে ন্যাপের কার্যনির্বাহী পরিষদের এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর সাথে যোগাযোগ করে ঐক্যের ব্যাপারে তাঁকে অনুরোধ জানান। এসময় তিনি সারাদেশ সফর করে জনগণকে গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পরার আহ্বান জানান। ২০ জানুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল চলাকালে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিল করার সময় ভাসানীপন্থী ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান আসাদ শাহাদাত বরন করলে একদিকে ছাত্র আন্দোলন অপরদিকে ভাসানীর জ্বালাও-পোড়াও-ঘেরাও আন্দোলনে পাকিস্তান সরকার দিশেহারা হয়ে পরে। ৭ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করে তাঁর সমর্থন চাওয়ার আগেই তিনি ছাত্রদের ১১ দফার প্রতি সমর্থন জানান। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী থাকাবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হলে ১৬ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী তাঁর গায়েবানা জানাযা শেষে পল্টনের বিশাল জনসভায় ভাষণে বলেন, “প্রয়োজন হলে ফরাসী বিপ্লবের মতো জেলখানা ভেঙ্গে মুজিবকে নিয়ে আসবো। দুই মাসের মধ্যে ১১ দফা কায়েম এবং রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া না হলে খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হবে।” ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হলে সান্ধ্য আইন জারীর মাঝেই ছাত্র-জনতা মিছিল বের করে। ভাসানী তাঁর জ্বালাও-পোড়াও-ঘেরাও আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। উত্তাল আন্দোলনের মুখে সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব ঐদিন রাতেই মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করে দীর্ঘ সময় রুদ্ধদার বৈঠকে মিলিত হন। রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে সেদিন ভাসানীও তাঁকে জড়িয়ে ধরে আবেগে আপ্লুত হন।
১০-১৩ মার্চ পিন্ডিতে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখ্যান করে আগে ১১-দফাকে আলোচনার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে বলেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি কৃষক সমিতির উদ্যোগে কুমিল্লার চিয়রায় অনুষ্ঠিত এক জনসভায় তিনি ১১ দফার দাবী শুধু শহরে সীমাবদ্ধ না রেখে গ্রামে-গঞ্জে, বাংলার ঘরে-ঘরে, বস্তিতে-বস্তিতে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান। একদিকে গোলটেবিল বৈঠক অন্যদিকে মওলানা ভাসানীর সরকার পতনের আন্দোলন অব্যাহতভাবে চলাকালে ২৪ মার্চ বাধ্য হয়ে আইয়্যুব খান ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। তাঁর এই সাফল্যে বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ আখ্যা দেন। ১৯৭০ সালের ১৯ এপ্রিল ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ও শ্রমিক ফেডারেশন মিলে বন্দীমুক্তি ও দাবী দিবস উপলক্ষে ঢাকা মহানগরীতে হরতাল পালন করে। বিকেলে পল্টনের জনসভায় মওলানা ভাসানী ইয়াহিয়ার হুকুমনামার তীব্র সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন।
১৯৭০’র নির্বাচন উপলক্ষে তাঁর নিজ দল নির্বাচন বয়কট করে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দান করলে ন্যাপ-এ ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। ঐ অবস্থাতেও নির্বাচনে মওলানা ভাসানীর নিস্ক্রিয়তা সম্পর্কে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম লিখেছেন, “৭০- এর জানুয়ারি থেকে নির্বাচনের ফল ঘোষণা পর্যন্ত হুজুর যা কিছু দক্ষিণপন্থীদের মতো বামপন্থীদেরও অভিযোগ ছিল যে, নির্বাচনের আগে মওলানার নিস্ক্রিয়তায় সামজতান্ত্রিক আন্দোলনে যেমন ইতিবাক প্রভাব পরেনি তেমনি ন্যাপও উপকৃত হয়নি বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পক্ষান্তরে লাভবান হয়েছে আওয়ামী লীগ। করেছেন যাতে তাঁর মুজিবের সুবিধা হয়, সেভাবেই করেছেন।”
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মারা যায় প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ এবং অগণিত পশুপাখি। প্রচন্ড অসুস্থ মওলানা ভাসানী ১০২ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় ১৬ নভেম্বর রাতের ট্রেনেই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছান। ১৮ নভেম্বর হাতিয়া, ১৯ নভেম্বর রামগতি, ২০ নভেম্বর ভোলা এবং ২১ নভেম্বর বরিশালের বিভিন্ন এলাকা সফর শেষে ২৩ নভেম্বর পল্টনের জনসভায় তিনি ক্রোধে ফেটে পরে পশ্চিম পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “ওরা কেউ আসেনি; আজ থেকে আমরা স্বাধীন; আমি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ।”
মওলানা ভাসানীর সেই ঐতিহাসিক বক্তব্যের পরেই কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন- ‘হায় আজ একি মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী।’ ৩০ নভেম্বর তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তানের আজাদী রক্ষা ও মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ুন’ শিরানামে এক প্রচারপত্র বিলি করেন এবং ৪ ডিসেম্বর পল্টনের জনসভায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একসঙ্গে থাকার যাবতীয় যৌক্তিকতা আগ্রাহ্য করে চূড়ান্ত দফা ‘স্বাধীনতা’ ঘোষণা করেন। বলেন “লাকুম দীনুকুম ওলিয়াদিন।”
কবি শামসুর রহমানের কবিতায় ফুটে উঠে, “…বল্লমের মতো ঝলসে ওঠে তার হাত বারবার
অতিদ্রুত স্ফীত হয়, স্ফীত হয়, মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবি,
যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবি দিয়ে সব
বিক্ষিপ্ত বে-আব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান।”
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী সেই সময় স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিলেন। ছাত্রনেতারা স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার করার সুযোগ পেলেন। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার অগ্রদূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ৭ মার্চের ভাষণ শুনে মওলানা ভাসানী হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি এত দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে মনে মনে এটাই চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন তিনি। তিনি ৯ মার্চ, ১৯৭১ সালে পল্টনে এই ভাষণ দেন। সে জন্যই দুদিন পর পল্টনের জনসভায় মওলানা ভাসানী বললেন, ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে।’ তিনি এও বললেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে আমরা স্বাধীনতা পেয়ে গেলে ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে। …………… সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না।’
জনসভায় মওলানা ভাসানী তুমুল করতালির মধ্যে বলেন, ‘মুজিবের নির্দেশমতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কিছু না হলে আমি শেখ মুজিবের সাথে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলব।’ পল্টনে সেই বিশাল জনসভায় মজলুম জননেতা দৃঢ় কণ্ঠে আরও বলেন, ‘অচিরেই পূর্ব বাংলা স্বাধীন হবে।’ তিনি সবাইকে শেখ মুজিবের ওপর আস্থা রাখতে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘শেখ মুজিব আমার ছেলের মতো, সে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না; বাঙালিরা মুজিবের ওপর আস্থা রাখেন, কারণ আমি তাকে ভালোভাবে চিনি।’ এই দিন তিনি তাঁর ভাষণের সঙ্গে ১৪ দফা দাবিও পেশ করেন। মওলানা ভাসানী এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন। দুই প্রধান নেতার একই সিদ্ধান্তে চলে আসার একটি উদাহরণ তৈরী হয়। তবে এ উদাহরণটি ইতিহাসের পাতায় আজ অনেকটাই অনুপস্থিত। প্রধান দুই নেতা একসঙ্গে একই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ঐকমত্য প্রকাশ করেন, তখন আর স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মওলানা ভাসানীর অবদানকে যারা অস্বীকার করতে চায় বা পাশ কাটিয়ে যেতে চায় তারা আসলে আত্ম প্রবঞ্চক।
[ রাজনীতিক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন ]
