ঢাকা, শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১
Logo
logo

অপরাজিত’য় জিতু কোথায়, এ তো সত্যই সত্যজিৎ! সাদা-কালোয় শ্রেষ্ঠ রূপকথা আঁকলেন অনীক


এনবিএস ওয়েবডেস্ক   প্রকাশিত:  ১৪ মে, ২০২২, ০১:০৫ পিএম

অপরাজিত’য় জিতু কোথায়, এ তো সত্যই সত্যজিৎ! সাদা-কালোয় শ্রেষ্ঠ রূপকথা আঁকলেন অনীক

অপরাজিত’য় জিতু কোথায়, এ তো সত্যই সত্যজিৎ! সাদা-কালোয় শ্রেষ্ঠ রূপকথা আঁকলেন অনীক

“শুনলাম নাকি এমন ছবির ডিরেক্টর যে ছবিতে হিরো, হিরোইন, গান কিছুই নেই!  ও কি পারবে আদৌ ছবি বানাতে? দূর দূর!!”

এমনই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ শুনতে হয়েছিল নবীন পরিচালকটিকে। কিন্তু তাঁর ভাবনার এই ছবি বাংলা ছবির বাঁকবদল ঘটিয়ে দিল (Aparajito)। বাণিজ্যিক ছবি ছাড়াও যে মননশীল আর্ট ফিল্ম হয় তা দেখিয়ে দিলেন তিনি। সে আর কেউ নয়, সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray)। আর তাঁর প্রথম নির্মিত ছবি ‘পথের পাঁচালী’। ১৯৫৪-১৯৫৫ সাল বাংলা ছবির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়। যখন একদিকে মূল ধারার ছবিতে নতুন যুগের হাওয়া আনল নতুন জুটি উত্তম-সুচিত্রার ‘অগ্নিপরীক্ষা’। তেমন সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম ছবিতেই ইতিহাস ঘটালেন। ছায়াছবির ধারাটাই তিনি বদলে দিলেন। তৈরি হল বাংলা ছায়াছবির দুটি ধারা আর্ট ফিল্ম আর কমার্শিয়াল ফিল্ম।

সত্যজিৎ ও তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণের কাহিনি নিয়েই অনীক দত্তর (Aneek Dutta) ছবি ‘অপরাজিত’ (Aparajito)। নামভূমিকায় জিতু কমল। ছবিতে যার নামও অপরাজিত রায়।

‘অপরাজিত’ (Aparajito) ছবি শুরুই হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের রেডিও সাক্ষাৎকার দিয়ে। যেখানে সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন স্বয়ং সাংবাদিক চিন্তক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবিতে অপরাজিত রায়ের মুখ দিয়েই আসছে ফ্ল্যাশব্যাকে ‘পথের পাঁচালী’ ওরফে ‘পথের পদাবলী’ নির্মাণের গল্প। যা কয়েকজন নব্য তরুণের স্বপ্ন-সফলের গল্প।
 যারা গতানুগতিক ফিল্ম স্টাইলকে ভেঙে নতুন কিছু করতে চেয়েছিল। তাই তারা নিজেরাই কয়েকজন মিলে তৈরি করল ‘কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি’। সেখান থেকেই ‘পথের পাঁচালী’র স্বপ্ন দেখা শুরু। বহু ঠোক্কর খেয়ে, প্রতিকূলতা জয় করে শেষমেশ স্বপ্নপূরণ। যে সত্যজিৎকে একদিন হেয় করেছিল টালিগঞ্জ পাড়া সেই সত্যজিৎই বাংলা ছবিকে গলি থেকে পৌঁছে দিল রেড কার্পেট পেরিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে।

চিরায়ত বাংলার অপরূপ আনন্দ-বেদনার আখ্যানে যে উপন্যাস রচনা করেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ সেলুলয়েডের মাধ্যমে তাঁকে নান্দনিক সুষমায় উদ্ভাসিত করেন। আর অনীক দত্ত যেন ‘অপরাজিত’ (Aparajito) ছবিতে সত্যজিতের আরাধনা করেছেন সুনিপুণভাবে।  ‘অপরাজিত’ ছবিটি অনীক বানিয়েছেন একদম সাদা-কালোতে। এর আগে এ যুগে ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর ‘দোসর’ ছবি বানিয়েছিলেন সম্পূর্ণ সাদা-কালোতে। যদিও দুটি ছবির প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা। সত্যজিতের জীবন ও ‘পথের পাঁচালী’ র নির্মাণের গল্প একটু নিজের মতো সাজিয়েছেন অনীক, কিন্তু তা যথার্থ। অনীকের ডেবিউ ছবি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর পর মাঝের ছবিগুলো যেন তাঁর ‘মাস্টার স্ট্রোক’ হচ্ছিল না।

কিন্তু এবার বলতে দ্বিধা নেই অনীকের শ্রেষ্ঠতম ছবিটি হল ‘অপরাজিত’। ছবিটি শুধু চোখকে আরাম দেয় না মনকে পরিশুদ্ধ করে। দেখার পর মনে হয় ছবি দেখা সার্থক। বোড়ালের সেই আদি গ্রামকে যেন এই টেকনোলজির যুগে ছুঁয়ে দেখলাম। সুপ্রতিম ভোলের সিনেমাটোগ্রাফি থেকে দেবজ্যোতি মিশ্রর মিউজিক অভূতপূর্ব যা সচরাচর এ যুগের বাংলা ছবিতে দেখা যায়নি। ‘অপরাজিত’ ছবির সেরা দৃশ্য কাশবনের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে অপু-দুর্গার রেলগাড়ি দেখতে যাওয়ার ক্লাইম্যাক্স। যে দৃশ্য পর্দায় ভেসে উঠলে গায়ে কাঁটা দেয় আর সারা প্রেক্ষাগৃহের দর্শক হাততালি দিয়ে ওঠে। মনে হয় না সত্যজিতের অনুকরণ-দৃশ্য। যেন অনীক নিজের প্রেমসুধারসে কবিতা রচনা করেছেন এ ছবিতে।

সত্যজিৎ রায় ওরফে অপরাজিত রায় রূপে জিতু কমল অসামান্য। একটা কথাই মনে হচ্ছে বারবার। ইন্ডাস্ট্রিতে চলচ্চিত্র অভিনেতাদের তুলনায় সিরিয়াল অভিনেতাদের ব্রাত্য চোখে দেখা হয়, সেটা যে কত ভুল তা প্রমাণ করলেন জিতু কমল। ‘অপরাজিত’তে জিতু কোথায়, এ তো সত্যজিৎ রায়। অমন এক আইকনিক চরিত্র হয়ে ওঠা কম কথা নয়। যার একটু ভুলচুক হলে বাঙালি ছেড়ে কথা বলবে না। কিন্তু সে জায়গাটাই দিলেন না অনীক এবং জিতু। বহু চলচ্চিত্র নায়কদের বাদ দিয়ে সিরিয়ালের এক অভিনেতাকে নেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন অনীক। অনীকের মান রেখেছেন জিতু। জিতুর অভিনয় দেখলে মনে হয় জীবন্ত সত্যজিৎ চোখের সামনে।

আর একজনের কথা না বললেই নয় তিনি চন্দ্রাশীস রায়। জিতুর কণ্ঠ ডাবিং করেছেন যিনি। চন্দ্রাশীষ আর জিতু একে অন্যের পরিপূরক। জিতু অসম্ভব ভাল সত্যজিতের বডি ল্যাঙ্গোয়েজ এবং পোশাক ক্যারি করেছেন। সোমনাথ কুণ্ডুর মেক-আপ ছাড়াও অসম্পূর্ণ রয়ে যেত জিতুর সত্যজিৎ হয়ে ওঠা। বাংলা ছবি এমন এক মেক-আপ আর্টিস্ট পেয়ে ধন্য। অনীক দত্ত, শ্রীপর্ণা মিত্র ও উৎসব মুখোপাধ্যায় ত্রয়ী টানটান চিত্রনাট্য রচনা করেছেন এবং অর্ঘ্যকমল মিত্রর সম্পাদনা অনবদ্য। প্রযোজক ফিরদৌসল হাসানের সফলতম প্রচেষ্টা।

সত্যজিৎ ঘরণী বিজয়া রায় রূপে সায়নী ঘোষ একদম পারফেক্ট। জিতুর সঙ্গেই সমান তালে সঙ্গত করে গেছেন সায়নী। বিজয়া এখানে বিমলা। বিজয়া রায় না থাকলে যে সত্যজিৎ রায় বা ‘পথের পাঁচালী’ গড়ে উঠত না। যার পছন্দেই সিলেক্ট হয় অপু আর দুর্গা। সত্যজিতের মা সুপ্রভা রায়ের চরিত্রে বেশ স্থিতধি অভিনয় করেছেন অনসূয়া মজুমদার। ‘পথের পাঁচালীর’র চরিত্ররাও ফিল্মে উপস্থিত। সর্বজয়া করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই জীবন বেদনার ছাপ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন অঞ্জনা বসু। অপুর চরিত্রে ছোট্ট শ্লোক চক্রবর্তী মন ভাল করে দেয়। অনুষা বিশ্বনাথন দুর্গা রূপে চমৎকার। তবে অনুষাকে যেন সত্যজিতের ‘তিন কন্যা’র মৃন্ময়ী লেগেছে বেশি।

সত্যজিতের ইন্দির ঠাকরুণ হয়েছিলেন চুনীবালা দেবী। সবাই এতদিন বলে এসেছে যাঁর বিকল্প হয় না। তবে অনীক সেই মিথ ভেঙে লোকশিল্পী অনামী পুরুষ অভিনেতা হরকুমার দত্তকেই সাজিয়েছেন তাঁর ইন্দির ঠাকরুণ। সোমনাথ কুণ্ডুর মেক-আপ যেখানে অবিশ্বাস্য। তবে যখনই হরবাবু মুখ খুললেন তাঁর কণ্ঠে পুরুষালি ভাব ফুটে উঠল। চুনীবালা দেবীর দাঁত ফোগলা হাসি আর কণ্ঠের সেই পেলব মিষ্টতা আনতে পারলেন না অনীকের ইন্দির ঠাকরুণ। কণ্ঠস্বরেই হরবাবু চুনীবালা হয়ে উঠতে পিছিয়ে পড়লেন। এ ব্যাপারে অনীক কেন নজর দিলেন না! ডাবিং তো করাই যেত। ভাল লেগেছে বিভূতিভূষণের স্ত্রীর ভূমিকায় মানসী সিনহার শান্ত অভিনয়।


ছবিতে অপরাজিত সত্যজিতের স্বপ্নদৃশ্যটি প্রশংসনীয়। কিন্তু সেখানে রবীন্দ্রনাথ ও ছোট্ট সত্যজিতের উপস্থিতি সোশ্যাল মিডিয়ায় চর্চিত ভুল ছবিকে মনে করায় যা বড্ড চোখে লাগল।

‘অপরাজিত’ প্রতিটি বিভাগ থেকে প্রতিটি চরিত্র একেবারে যত্ন নিয়ে বানিয়েছেন অনীক। যা বোধহয় খুব কম ছবিতেই হয়। তবে ছবিতে শুধু সত্যজিতের ওপরই ডিটেল ওয়ার্ক করেননি অনীক, চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের সমগ্র ইন্ডাস্ট্রিকে যেন তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছেন। কখনও ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘মেজ দিদি’ কাননবালার ছবি, কখনও বা আবহে ভেসে আসছে টকি ফিল্ম স্টাইলে গান আবার কখনও সত্যজিতের শ্যুটিং এর মাঝেই স্টুডিওতে হাজির হচ্ছেন তৎকালীন খ্যাতনামা নায়িকা প্রযোজিকা সুনন্দা দেবী। এই ডিটেলিংয়ের জন্য অনীক ও তাঁর টিমের প্রশংসা প্রাপ্য।

তবু এত ভালর পরেও আমাদের বাঙালিদের গলায় খচখচ করছে কাঁটা। এমন সত্যজিৎ আশ্রিত ছবি প্রদর্শন করা গেল না সত্যজিতের স্বপ্নের হল ‘নন্দন’-এ। এ বাঙালির লজ্জা। বাঙালি হিসেবে আমরা লজ্জিত। রাজনৈতিক মতান্তরের হিংসাত্মক রেশ কেন এসে পড়ল সত্যজিৎ রায়ের উপর? প্রতিটি বাঙালি দর্শকের প্রাণ জুড়ত এমন একখানি ছবি যদি তাঁরা নন্দনে বসেই দেখতে পেতেন। কিন্তু আমাদের রাজ্য বোধহয় সে সৌজন্যবোধ হারিয়েছে। বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে ব্যক্তিগত সমীকরণকে লঘু করে দেখতে হয়, এ কথা ভুলে গেল সরকার কর্তৃপক্ষ। সত্যজিৎ রায়ের শতবর্ষ যে রাজ্যে ঘটা করে পালন করা হয় অথচ তাঁর ছবিই তাঁর হাতে গড়া হলে জায়গা পায় না। এর থেকে লজ্জার, দুঃখের আর কী হতে পারে! রাজ্যের সংস্কৃতি জগত চুপ!

কেন ছবি ‘নন্দন’এ মুক্তি পেল না তার উত্তর ছবির ভেতরই রয়েছে। মিথ ভাঙা কাজের পথ চিরকালই কন্টকাকীর্ণ হয়। আর সেটাই তার চ্যালেঞ্জ।

তবু ‘অপরাজিত’ মুক্তি পেয়েছে বেশ কিছু অভিজাত প্রেক্ষাগৃহে বিশেষত মাল্টিপ্লেক্সে। টিকিটের দাম বেশি হলেও এ ছবি মিস করবেন না, দেখে আসুন। গ্যারান্টি দিতে পারি টিকিটের টাকা নষ্ট হবে না বরং এক মুহূর্তের জন্য চোখ সরবে না পর্দা থেকে। সত্যজিৎ ভক্ত সহ সকল বাঙালির প্রাণের ছবি হতে চলেছে ‘অপরাজিত’ আর অপরাজিত রায় জিতু কমল।।খবর দ্য ওয়ালের /এনবিএস/২০২২/একে