এনবিএস ডিজিটাল ডেস্ক প্রকাশিত: ১২ আগস্ট, ২০২৫, ০৮:০৮ এএম
একটি বিমান আছড়ে পড়ল, চারিদিকে ধ্বংসস্তূপ, ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর কান্না। কিন্তু ঠিক তখনই অনুসন্ধানকারীদের নজর পড়ে একটিমাত্র যন্ত্রে—‘ব্ল্যাক বক্স’। কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এই যন্ত্র? কেন এটি ছাড়া জানা যায় না দুর্ঘটনার আসল কারণ? কমলা রঙের এই যন্ত্র কীভাবে আগুন, বিস্ফোরণ এমনকি গভীর সমুদ্রেও অক্ষত থাকে? আর এর মধ্যেই লুকানো থাকে শেষ মুহূর্তের ভয়াবহ সত্য। আজ আমরা জানবো, ‘ব্ল্যাক বক্স’ আসলে কী দিয়ে তৈরি, কীভাবে কাজ করে, আর কেন প্রতিটি উড়ন্ত বিমানের সঙ্গে এটিই সবচেয়ে নীরব অথচ শক্তিশালী সাক্ষী হয়ে থাকে।
বিমান দুর্ঘটনার খবর আমরা প্রায়ই শুনি। কিন্তু যখনই এমন কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, তখন তদন্তকারীদের প্রথম লক্ষ্য থাকে বিমানের ‘ব্ল্যাক বক্স’ উদ্ধার করা। কেন এই বাক্স এত গুরুত্বপূর্ণ? কীভাবে এটি তৈরি হয় যে ভয়াবহ দুর্ঘটনাতেও এটি অক্ষত থাকে? আর এই বাক্সে এমন কী তথ্য থাকে যা দুর্ঘটনার আসল কারণ খুঁজে বের করতে সাহায্য করে? আজকের এই ভিডিওতে আমরা ব্ল্যাক বক্সের রহস্য উন্মোচন করব। আমরা জানব এর ইতিহাস, কীভাবে এটি কাজ করে, কী দিয়ে তৈরি, এবং কেন এটি বিমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
নামে ‘ব্ল্যাক বক্স’ হলেও এটি আসলে কালো নয়, বরং উজ্জ্বল কমলা রঙের। এই রঙের কারণ হলো, বিমানের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এটি যেন সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। ব্ল্যাক বক্স আসলে দুটি যন্ত্রের সমন্বয়ে তৈরি: ককপিট ভয়েস রেকর্ডার -সিভিআর এবং ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার -এফডিআর। এই দুটি যন্ত্র একসঙ্গে বিমানের সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষণ করে, যা দুর্ঘটনার তদন্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ককপিট ভয়েস রেকর্ডার পাইলট ও সহকারী চালকের মধ্যে কথোপকথন, রেডিয়ো তরঙ্গ, ইঞ্জিনের শব্দ এবং অন্যান্য শব্দ রেকর্ড করে। এই তথ্য থেকে তদন্তকারীরা বুঝতে পারেন পাইলটরা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, বিমান ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে তাঁদের কী কথা হয়েছিল, এবং ইঞ্জিনে কোনও সমস্যা ছিল কি না। অন্যদিকে, ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার বিমানের উচ্চতা, গতি, দিক, ডানার অবস্থান, জ্বালানি স্তর এবং আরও হাজারো তথ্য রেকর্ড করে। কিছু আধুনিক ব্ল্যাক বক্স এমনকি বিমানের হাজারেরও বেশি বৈশিষ্ট্যের তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে।
এই তথ্যগুলো থেকে তদন্তকারীরা একটি কম্পিউটার অ্যানিমেশন তৈরি করতে পারেন, যা দুর্ঘটনার আগের মুহূর্তগুলো পুনর্গঠন করে। এটি তদন্তকারীদের বুঝতে সাহায্য করে যে দুর্ঘটনার ঠিক আগে কী ঘটেছিল।
ব্ল্যাক বক্সের ধারণা প্রথম আসে ১৯৫৩ সালে, যখন অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী ডেভিড ওয়ারেন বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক জেট বিমান ‘দ্য কমেট’-এর দুর্ঘটনার তদন্ত করছিলেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, যদি ককপিটে পাইলটদের কথোপকথন ও অন্যান্য শব্দ রেকর্ড করা যায়, তবে তা দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতে অনেক সাহায্য করবে। এই চিন্তা থেকেই তিনি ১৯৫৬ সালে একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করেন। এই যন্ত্রটির সম্ভাবনা বুঝতে পেরে বিশ্বের বাণিজ্যিক বিমান সংস্থাগুলো এটি ব্যবহার শুরু করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্ল্যাক বক্স আরও উন্নত ও আধুনিক হয়েছে।
১৯৬০-এর দশকে ব্ল্যাক বক্স বাণিজ্যিক বিমানে বাধ্যতামূলক করা হয়। আজকাল প্রতিটি বাণিজ্যিক বিমানে এই যন্ত্র থাকা আবশ্যক। এটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে এটি স extreme পরিস্থিতিতেও টিকে থাকে।
ব্ল্যাক বক্স এমন একটি যন্ত্র যা অত্যন্ত শক্তিশালী উপকরণ দিয়ে তৈরি। সাধারণত টাইটানিয়াম বা স্টেনলেস স্টিল ব্যবহার করা হয়, যা প্রচণ্ড আঘাত, উচ্চ তাপমাত্রা এবং গভীর সমুদ্রের চাপ সহ্য করতে পারে। এই বাক্সগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে ৩৪০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা এবং ৫০০০ পাউন্ড প্রতি বর্গ ইঞ্চি চাপেও এটি অক্ষত থাকে। এমনকি সমুদ্রে ডুবে গেলেও এটি ১৪ হাজার ফুট গভীরতা থেকে সংকেত পাঠাতে পারে।
ব্ল্যাক বক্সের কমলা রঙের আরেকটি কারণ হলো এটি সহজে দৃশ্যমান। ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এই উজ্জ্বল রঙ দ্রুত খুঁজে পেতে সাহায্য করে। এ ছাড়া, ব্ল্যাক বক্সে একটি আন্ডারওয়াটার লোকেটর বীকন থাকে, যা দুর্ঘটনার পর ৩০ দিন পর্যন্ত সংকেত পাঠাতে পারে। এই সংকেতের মাধ্যমে সমুদ্রের গভীর থেকেও বাক্সটি উদ্ধার করা সম্ভব।
ককপিট ভয়েস রেকর্ডার সাধারণত বিমানের ককপিটে এবং ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার বিমানের পেছনের অংশে বসানো হয়। এই দুটি অবস্থান বেছে নেওয়া হয় কারণ এই অংশগুলো দুর্ঘটনার সময় তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ব্ল্যাক বক্সের কাজ হলো বিমানের সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষণ করা। ককপিট ভয়েস রেকর্ডার সাধারণত দুই ঘণ্টার কথোপকথন রেকর্ড করে। এটি একটি লুপ রেকর্ডিং সিস্টেম ব্যবহার করে, যার মানে পুরোনো রেকর্ডিংয়ের উপর নতুন রেকর্ডিং লেখা হয়। তবে আধুনিক ব্ল্যাক বক্সে এই সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।
ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার বিমানের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পরামিতি রেকর্ড করে। এর মধ্যে রয়েছে: বিমানের উচ্চতা, বায়ুর গতি, বিমানের দিক ও গতিবেগ, ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতা, ডানার অবস্থান, জ্বালানির মাত্রা, ধোঁয়া বা আগুনের অ্যালার্ম। এই তথ্যগুলো তদন্তকারীদের দুর্ঘটনার কারণ বুঝতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ইঞ্জিনে কোনও ত্রুটি থাকে, তবে তা ইঞ্জিনের শব্দ বা ফ্লাইট ডেটা থেকে বোঝা যায়। আবার, পাইলটদের কথোপকথন থেকে বোঝা যায় তাঁরা কোনও জরুরি পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন কি না।
ব্ল্যাক বক্স বিমান দুর্ঘটনার তদন্তে একটি অপরিহার্য হাতিয়ার। এটি তদন্তকারীদের দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতে সাহায্য করে, যা ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে, তবে তা চিহ্নিত করে বিমান নির্মাতারা সেই ত্রুটি সংশোধন করতে পারেন। আবার, যদি পাইলটের ভুলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে, তবে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে পাইলটদের প্রশিক্ষণ উন্নত করা যায়।
যদিও ব্ল্যাক বক্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবুও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্ল্যাক বক্স থেকে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্যাঙ্কক থেকে দক্ষিণ কোরিয়াগামী জেজু এয়ারের একটি বিমান দুর্ঘটনায় ১৮১ জন আরোহীর মধ্যে ১৭৯ জন নিহত হন। কিন্তু সেই বিমানের ব্ল্যাক বক্স থেকে কোনও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি। এমন ঘটনা ঘটে যখন বাক্সটি অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা তথ্য রেকর্ডিংয়ে কোনও ত্রুটি থাকে।
আরেকটি সমস্যা হলো, ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করতে অনেক সময় লেগে যায়, বিশেষ করে যখন বিমান সমুদ্রে ডুবে যায়। এমন ক্ষেত্রে গভীর সমুদ্র থেকে বাক্সটি উদ্ধার করা একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। তবে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এই প্রক্রিয়া অনেক সহজ হয়েছে।
ব্ল্যাক বক্সের প্রযুক্তি ক্রমশ উন্নত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এখন এমন ব্ল্যাক বক্স তৈরির চেষ্টা করছেন যা রিয়েল-টাইমে তথ্য পাঠাতে পারে। এর মানে, বিমান দুর্ঘটনার আগেই সব তথ্য ক্লাউডে সংরক্ষিত হবে, যাতে বাক্সটি উদ্ধারের প্রয়োজন না হয়। এই প্রযুক্তি বাস্তবায়িত হলে তদন্ত প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ও নির্ভুল হবে।
তাছাড়া, কিছু বিশেষজ্ঞ প্রস্তাব দিয়েছেন যে ব্ল্যাক বক্সে আরও বেশি তথ্য সংরক্ষণের সক্ষমতা বাড়ানো উচিত। উদাহরণস্বরূপ, ককপিটের ভিডিও রেকর্ডিং যোগ করা যেতে পারে, যা তদন্তকারীদের আরও বিস্তারিত তথ্য দেবে। তবে এই প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কারণ এটি পাইলটদের গোপনীয়তার বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।
ব্ল্যাক বক্স কীভাবে তদন্তে সাহায্য করে, তা বোঝার জন্য কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ দেখা যাক। ২০০৯ সালে এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৪৭ আটলান্টিক মহাসাগরে বিধ্বস্ত হয়। দুই বছর ধরে ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা যায়নি। কিন্তু যখন এটি উদ্ধার করা হয়, তখন তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে পাইলটদের ভুল সিদ্ধান্ত এবং বিমানের সেন্সরে ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। এই তথ্যের ভিত্তিতে বিমানের নকশা ও পাইলটদের প্রশিক্ষণে পরিবর্তন আনা হয়।
আরেকটি উদাহরণ হলো ২০১৪ সালের মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স ফ্লাইট এমএইচ৩৭০। এই বিমানটি ভারত মহাসাগরে নিখোঁজ হয়, এবং ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফলে দুর্ঘটনার কারণ এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। এই ঘটনা ব্ল্যাক বক্সের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
অহমদাবাদের এয়ার ইন্ডিয়ার দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও ব্ল্যাক বক্স এখন তদন্তের প্রধান আশ্রয়। এই বাক্স থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে তদন্তকারীরা জানতে পারবেন যে দুর্ঘটনাটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঘটেছে, নাকি পাইলটদের কোনও ভুলের কারণে, বা অন্য কোনও বাহ্যিক কারণ ছিল।
ব্ল্যাক বক্স একটি ছোট্ট যন্ত্র হলেও এটি বিমান চলাচলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য অংশ। এটি শুধু দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতেই সাহায্য করে না, বরং ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অহমদাবাদের দুর্ঘটনার মতো ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বিমান চলাচলের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য আরও উন্নত প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।
আপনারা এই বিষয়ে কী ভাবছেন? ব্ল্যাক বক্সের প্রযুক্তি কি আরও উন্নত হওয়া উচিত? নাকি এটি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট কার্যকর? কমেন্ট সেকশনে আপনাদের মতামত জানান।
ব্ল্যাক বক্স বিমান দুর্ঘটনার তদন্তে একটি নিঃশব্দ সাক্ষীর ভূমিকা পালন করে। এটি আমাদের বলে দেয় যে আকাশে কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল, এবং কীভাবে তা রোধ করা যেতে পারে। অহমদাবাদের দুর্ঘটনার তদন্তে ব্ল্যাক বক্স কী তথ্য দেবে, তা জানার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। এই ধরনের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রযুক্তি আমাদের জীবন বাঁচাতে পারে, কিন্তু তার সঠিক ব্যবহার ও উন্নতি জরুরি।