গুজরাটের দু’টি জেলায় অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ঘোষণা, তীব্র সমালোচনায় সোচ্চার বিরোধীরা

ভারতে বিজেপিশাসিত গুজরাটের দু’টি জেলায় অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাজ্যটিতে আসন্ন নির্বাচনের মুখে কেন্দ্রীয় সরকারের ওই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন বিরোধীরা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, গুজরাটের আনন্দ ও মেহসানা জেলায় বসবাসকারী মুসলিম বাদে ৬টি ধর্মাবলম্বী অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি  এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী যারা বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে এসেছেন, তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে সংশ্লিষ্ট জেলার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভারতে ন্যূনতম পাঁচ বছর থাকতে হবে এমন কোনও শর্তও এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।  

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ২০১৯ সালের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)-এর পরিবর্তে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের আওতায় নাগরিকত্ব দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসি এবং খ্রিশ্চান ধর্মাবলম্বীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দিতেই ২০১৯ সালে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন তৈরি হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আইন তৈরি হলেও কেন্দ্রীয় সরকার এখনও এর বিধি (রুল ফ্রেমিং) তৈরি করতে সমর্থ হয়নি। এর ফলে ওই আইনে এখনও কেউ নাগরিকত্ব পাননি।     

গুজরাটে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের মুখে ‘অমুসলিম শরণার্থীদের’ ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার ঘোষণার মধ্যে দিয়ে ভোটে জিততে বিজেপি এভাবে চিরাচরিত হিন্দু তাসের রাজনীতি শুরু করে দিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 

এ প্রসঙ্গে কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গের সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী এমপি বলেন, ‘এটা ওদের সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা। নতুনত্ব কিছু না। যখন সময় হবে তখন এগুলো ব্যবহার হবে। পশ্চিমবঙ্গে গতবার নির্বাচনের সময়ে ব্যবহার হয়েছিল নাগরিকত্ব  আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)। নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে নাগরিকত্ব আইন বন্ধ, ‘এনআরসি’ বন্ধ। এতে লাভ হল কার? ‘দিদি’ (মমতা) আর মোদীর। এগুলো করার মধ্য দিয়ে সমাজের অগ্রগতি, উন্নতি, উন্নয়ন, রুটি-রুজি, জিনিসের দাম কমানোর বার্তা নেই। এগুলো করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের আগে সাম্প্রদায়িক বিভাজনে বিভক্ত করে নির্বাচনের বাতাবরণ বিষময় করে তুলে ভোট অর্জন করাই উদ্দেশ্য।’

তিনি বলেন, ‘সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে নাগরিকত্ব দেওয়ার নামে ‘অমুসলিম’ শব্দ ব্যবহার করা মানে একটা সম্প্রদায়কে আক্রমণ করার একটা আইন। কত অমুসলিম নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য কাজ করেছে? ওরা (বিজেপি) বলে লক্ষ লক্ষ। কিন্তু লক্ষ লক্ষ নয়, ত্রিশ হাজার মাত্র, তাও বহু বছর ধরে। তারা এখন পাকিস্তানের দূতাবাসে গিয়ে দরখাস্ত করছে যে, আমাদেরকে আবার পাকিস্তানে ফেরত নিয়ে চলো। কারণ, ভারতবর্ষে এসে যে কথা বলা হয়েছিল, সেই নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি। এটাই হচ্ছে সরকারের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির একটা জ্বলন্ত উদাহরণ।’

অধীর বাবু আরও বলেন, ‘ভারতবর্ষ সকলের দেশ। হিন্দু-মুসলমান সকলের দেশ এই ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষের আইন ভারতের সকলের জন্য। সেখানে ‘অমুসলিম ‘অমুসলিম’ করে ভারতবর্ষের সংবিধানকে অবজ্ঞা করা শুধু নয়, ভারতবর্ষের আমাজ ব্যবস্থাকে বিভাজিত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র হচ্ছে, আমরা তার প্রতিবাদ  করেছি, আজও করব’ বলেও মন্তব্য করেন পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী এমপি। 

অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূলের মুখপাত্র শান্তনু সেন এমপি বলেছেন, ‘আমরা এর আগে দেখেছি ‘সিএএ’-‘এনআরসি’ নিয়ে দ্বৈরথ এবং তাদের নিজেদের মধে যে অস্থিরতা সেতা আমরা লক্ষ্য করেছি। আড়াই বছর আগে একটা বিল গায়ের জোরে পাস করানোর পরেও সেটা আজ পর্যন্ত রুল ফ্রেম করতে পারল না। আবার নির্বাচনের আগে এক সম্প্রদায়ের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য এবং ধর্মের নামে মানুষকে বিভাজন তৈরি করার জন্য তারা এসব বিভিন্ন রাজনীতির পথে হাঁটছে। তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান এক্ষেত্রে খুব স্পষ্ট। আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার বলেছেন, যারা ভারতবর্ষে দীর্ঘদিন ধরে আছেন, যাদের ভোটার কার্ড আছে, যারা ভোট দিয়ে রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্বাচিত করেন তারা প্রত্যেকে ভারতের নাগরিক। নতুন করে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। এ ধরণের সস্তা নিরবাচনী চমক দেশের মানুষ এখন বুঝে গেছে’ বলেও মন্তব্য করেন তৃণমূলের মুখপাত্র শান্তনু সেন এমপি।   

অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা ও বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, ‘এটা ‘সিএএ’র পার্ট। ‘সিএএ’ বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গেও তা হবে। ‘সিএএ’ আইন তো সংসদের উভয় কক্ষেই পাশ করা আছে।  আমরা অপেক্ষা করছিলাম। নিশ্চয় তাহলে ওই আইনের রুল তৈরি হয়ে গেছে। একই রুলে পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া সমাজ, নমশূদ্র সমাজ সুবিধা পাবে বলেও মন্তব্য  করেন বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী।   

শুভেন্দু অধিকারীর পাল্টা জবাবে তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘যারা ওপার বাংলা থেকে থেকে এসেছেন তারা আমাদের এখানে নাগরিক। তারা এখানে মূল স্রোতে আছেন, বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে আছেন, পদে আছেন, জনপ্রতিনিধি আছেন, সবকিছুতে আছেন। শুভেন্দু অধিকারী ক’দিন আগে বলেছিল, এই সমস্ত বিভেদ করে বিজেপি দেশটার সর্বনাশ করছে, আজকে ওর এবং ওর মত এরকম যে ক’জন বিজেপির লোকজন আছেন, গুজরাটে ‘সেতু বিপর্যয়’ থেকে নজর ঘোরাতে, দেশকে অন্য ইস্যুতে ব্যস্ত করে দিতে এ ধরণের একটা হাওয়া বাজারে ছাড়ছে’ বলেও মন্তব্য করেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র কুণাল ঘোষ।
 খবর পার্সটুডে/এনবিএস/২০২২/একে

news