ভিন্ রাজ্যের দূষণ ঠেকাতে সীমান্তে গাছের প্রাচীর, কতটা সঠিক ভাবনা
সারা দেশের বিশিষ্ট পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুললেন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সাম্প্রতিক পরিকল্পনা নিয়ে যেখানে বাইরের রাজ্য থেকে আসা বায়ুদূষণ আটকাতে (Air Pollution Control) রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত বরাবর বিপুল পরিমাণ গাছের প্রাচীর (Tree Wall) তৈরি করার কথা বলা হয়েছে। দূষণ পর্ষদের দাবি এমন ব্যবস্থা নিলে সীমান্তের বাইরে থেকে আসা বায়ু দূষণের একটা বড় অংশ আটকানো যাবে, যা তাদের মতে রাজ্যের সামগ্রিক বায়ুদূষণের অর্ধেকের জন্য দায়ী।
পরিবেশ দপ্তরের সূত্র অনুযায়ী পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান এবং ঝাড়গ্রামের সীমান্ত বরাবর প্রায় ৮০০ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে এই গাছ লাগানো হবে। সম্প্রতি রাজ্যের পরিবেশ মন্ত্রী মানস ভূঁইয়া দূষণ পর্ষদের এই ‘ইউনিক’ পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন পর্ষদের আধিকারিকদের উপস্থিতিতে। দেশে কোথাও এমন পরিকল্পনা আগে হয়নি। মন্ত্রী যদিও মেনে নেন যে এই পরিকল্পনার রূপায়ণ করতে বেশ কয়েক বছর লাগবে।
পর্ষদের প্রধান কল্যাণ রুদ্র জানান, রাজ্যের ৫০ শতাংশ দূষণের জন্য দায়ী বাইরে থেকে আসা দূষিত পদার্থয় তিনি দাবি করেন, গাছ প্রাচীর লাগিয়ে সেই দূষণের অনেকাংশই কমানো যাবেl পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র্য পর্ষদকে এই প্রকল্পটি কার্যকর করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞরা স্পষ্টই জানিয়েছেন যে সীমান্তে গাছ-প্রাচীর করে সরাসরি আন্তঃরাজ্য দূষণ আটকানো সম্ভব নয়। ‘সমগ্র অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক উৎস থেকে দূষণ কমাতে একটি আঞ্চলিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। গাছের প্রাচীর করে বড়োজোর কিছু পরিমাণে ধুলো আটকানো যেতে পারে যদি সেই প্রাচীর অনেক বড় অঞ্চল জুড়ে তৈরি হয়’, জানালেন পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের বিশেষজ্ঞ অনুমিতা রায় চৌধুরী। 
একমত অন্য বিশেষজ্ঞরাও। ‘আমাদের গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী আন্তঃসীমান্ত বায়ু দূষণ, বিশেষত অত্যন্ত বিষাক্ত ও সুক্ষাতিসুক্ষ পিএম ২.৫, শীতকালে সাধারণত মাটির কমপক্ষে ৫০০ মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় ও তার ফলে গাছের প্রাচীরে সরাসরি সেই দূষণ আটকানোর কথা নয়’ বলেন, বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা বোস ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী অধ্যাপক অভিজিৎ চ্যাটার্জী।
‘ঋতু এবং জলবায়ুর উপর ভিত্তি করে আন্তঃসীমান্ত দূষণ মাটির ৫০০ মিটার থেকে দু কিলোমিটারের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, এবং সে কারণে সীমানার বাইরে থেকে বাংলায় প্রবাহিত যে কোনও দূষণ মোকাবিলায় বায়ো-শিল্ডের সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই’, মত গুফরান বেগের, যিনি একজন বায়ু দূষণ বিশেষজ্ঞ এবং ভারত সরকার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘সিস্টেম অফ এয়ার কোয়ালিটি ফোরকাস্টিং অ্যান্ড রিসার্চ’’ (সফর) নেটওয়ার্কের প্রধান ।
কানপুর আইআইটি’র বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শচীন ত্রিপাঠীরও মত যে সীমান্তে গাছ লাগিয়ে ‘ট্রান্সবাউন্ডারি’ বায়ুদূষণ সরাসরি আটকানো যায় না।
সব বিজ্ঞানীই মেনে নিয়েছেন যে সরাসরি তেমন কোন ভূমিকা না থাকলেও সামান্য মাত্রায় দূষণ গাছের কারণে কমতে পারে যখন ভেসে আসা কিছু দূষক নিচের দিকে নেমে আসে বা স্থানীয় ভাবে কোন দূষণ তৈরি হয়। 
বৃক্ষরোপণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন প্রকল্প রূপায়ণে সরকারের বেশ কিছু কোটি টাকা খরচ হবে। ‘যদি আমরা ধরে নিই যে অন্তত দু মিটার দূরত্বে গাছগুলি লাগানো হবে, তাহলেও এক সারি বসাতে প্রায় চার লক্ষ গাছ লাগাতে হবেl গাছের মৃত্যুহার ও রক্ষণাবেক্ষণ বিবেচনা করলে খরচ হওয়ার কথা আনুমানিক ১২ কোটি টাকা। যদি গাছের একাধিক সারি লাগানো হয় তবে খরচ কয়েকগুণ বাড়তে পারে’ জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরি, যিনি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান যেটি পশ্চিমবঙ্গ এবং দেশের অন্যান্য জায়গায় লক্ষ লক্ষ গাছ লাগিয়েছে৷ যদিও প্রকল্পমূল্য নিয়ে দূষণ পর্ষদ বা জীববৈচিত্র্য পর্ষদ এখনও কোন মন্তব্য করেনি।
পরিবেশ সংগঠন সবুজ মঞ্চের বক্তব্য, ‘যদি এটি এতই কার্যকর হয় তবে দিল্লির মতো অঞ্চলে, যেটি আন্তঃসীমান্ত দূষণ দ্বারা এত বেশি প্রভাবিত, কেন এমন পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে না? আসলে দূষণ কমানোর নামে এই প্রকল্পে টাকা নষ্ট ছাড়া কিছুই হবে না।’ পরিবেশবিদদের একাংশের বক্তব্য, ‘এটা আশ্চর্যের যে পরিবহণ বা নির্মাণকার্যের মত বিষয় যেগুলি যেখান থেকে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি হয়, সেগুলিতে নজর না দিয়ে রাজ্য দূষণ পর্ষদ এমন অবৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা করে টাকা নষ্ট করতে চাইছে।

খবর দ্য ওয়ালের /এনবিএস/২০২২/একে

news