ঢাকা, শনিবার, জুলাই ২৭, ২০২৪ | ১২ শ্রাবণ ১৪৩১
Logo
logo

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কমেছে জবি শিক্ষার্থীদের খাবার গ্রহণ


এনবিএস ওয়েবডেস্ক   প্রকাশিত:  ১০ মার্চ, ২০২৩, ০৬:০৩ পিএম

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কমেছে জবি শিক্ষার্থীদের খাবার গ্রহণ

 দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কমেছে জবি শিক্ষার্থীদের খাবার গ্রহণ

কয়েকমাস আগেও সপ্তাহে পর্যায়ক্রমে মাংস, মুরগী,ডিম ও সবজি খেতে পারতেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী তৌফি (ছদ্মনাম)। যতটা খাবার প্রয়োজন খেতে পারতেন। কিন্তু সম্প্রতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পাল্টে গেছে তৌফির প্রেক্ষাপট। লাগাম টানতে হয়েছে দৈনন্দিন খাবারের ব্যবস্থায়।

 এখন মাছ-মাংস কিংবা ডিম নয়, দিনের পর দিন সবজি-ভায় খেয়েই কাটাচ্ছে এই শিক্ষার্থী। এমনকি মাঝে মধ্যে তিনবেলার জায়গায় দুইবেলাও খাবার খেতে হয় তার।

চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নিয়ন (ছদ্মনাম)। থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই একটি মেসে। চলেন টিউশনি করিয়ে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে খরচের পাল্লায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে বিগত ১ মাস ধরে পরিমাণ কমিয়েছে খাবার ও বাজারের৷ আগে যেখানে মাসের অধিকাংশ সময়েই মাছ বা মুরগী খেয়ে চলতো সেখানে এখন শাক-সবজিই একমাত্র ভরসা। আর ছোট মাছ বা ডিম কিনলে কম খেয়েই একদিনের জায়গায় দুইদিন চালান এই শিক্ষার্থী। বিগত ১৫দিনে একদিনও মাছ কিংবা মাংস খাবারের সুযোগ হয়নি তার। শুধু খাবার নয় খরচ বেড়েছে সার্বিক জীবনব্যবস্থারই।

তৌফি বা নিয়ামতউল্লাহর মত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীদের অনেকেই খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছেন। খাবারের মূল্যবৃদ্ধিসহ জীবনযাত্রার সার্বিক ব্যয় বৃদ্ধিকে এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন তারা। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসিক হল ও ক্যান্টিন থাকলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সুযোগ নেই৷

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে রয়েছে মাত্র একটি ক্যান্টিন। এখানেও নেই পর্যাপ্ত পরিমাণ ভর্তুকি। আগের দাম থাকলেও পরিমাণ কমানো হয়েছে খাবারের। একমাত্র সেই ক্যান্টিনে সকালে নাস্তায় প্রতিটি শিক্ষার্থীর খরচ হয় ৩০-৪০ টাকা৷ দুপুরে ভাত-মাছ ৪৫টাকা,ভাত-মুরগী ৪৫টাকা, ভাত-ডিম-ভর্তা-ডাল ৩৫ টাকায় খাওয়া যায়৷ তবে প্রতিবেলাতেই খাবার শেষ হয়ে যায় নির্ধারিত সময়ের আগেই। এতে করেও অনেক শিক্ষার্থীই বঞ্চিত হয় খাবারের সুযোগ থেকে।

আর একসাথে মাত্র ৪৮ জন শিক্ষার্থী খাবার খেতে পারে ক্যান্টিনে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। জায়গার স্বল্পতায় অনেকে দাঁড়িয়ে বা বাইরে খেতে বাধ্য হয়। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ক্যান্টিনে সকাল,দুপুর ও সন্ধ্যার খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও নেই রাতের খাবারের ব্যবস্থা। নেই পর্যাপ্ত ভর্তুকিও। শিক্ষার্থীদের দাবি ক্যান্টিনের সংখ্যা বাড়িয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভর্তুকির দিলে কম দামে পরিমাণমতো খাবারের সুযোগ পাওয়া যেতো।

 বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতেও (ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র) খাবারের চিত্র একই। টিএসসিতে যেসব খাবারের দোকান আছে সেখানেও পর্যাপ্ত মনিটরিংয়ের সুযোগ না থাকায় দাম বেশি হলেও নিশ্চিত হয়নি খাবারের মান। এখানে একটি পাউরুটির দামই ২০টাকা। একজন শিক্ষার্থী সকালের নাস্তায় রুটি-কলা ও চা খেলে খরচ হয় ৪০-৫০ টাকা।

আর ভাত-মাছ,ভাত-মাংস বা খিচুড়ির দামও লাগামহীন এখানে। টিএসসিতে মুরগী-ভাত ৭০ টাকা, মাছ-ভাত ৭০টাকা,খিচুড়ি ৪৫-৫০ টাকা। এছাড়াও পাউরুটি,ডিম,ভাজির দামও তুলনামূলক বেশি৷ জায়গা স্বল্পতায় এখানে গড়ে উঠেনি স্বাভাবিক পরিবেশ। তাতেও বাধ্য হয়েই খাবার গ্রহণ করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

ব্যতিক্রম নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রী হল 'বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল'। এখানের রান্নার পরিবেশ আর মান নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। ছাত্রী হলে প্রতি ভাতের প্লেট ১০টাকা,পাতলা ডাল ২টাকা,ভর্তা-শাক ১০টাকা,রুই,সরপুঁটি,কাতলা, পাঙ্গাস,তেলাপিয়া ও কই মাছের দাম (প্রতি পিস) ৩০টাকা, পাবদা ও ইলিশ মাছ (প্রতি পিস) ৩৫টাকা, ছোটমাছ ও চিংড়ি ৩৫টাকা, দেশী মুরগী ৪০ টাকা, ব্রয়লার ৩০টাকা, মুরগী খিচুড়ি ৫০টাকা,তেহারী ৭০ টাকা (ছোট একটুকরো মুরগীর মাংস সহ), মুড়িঘণ্ট ২৬টাকা এবং শাকের সাথে মাছের মাথা ভুনা ১৫টাকা।

 দাম পরিবর্তন না করলেও প্রতিটি আইটেমের পরিমানই কমানো হয়েছে। আবার মাঝেমধ্যেই খাবারের মধ্যেই তেলাপোকা সহ বিভিন্ন পোকামাকড় পাওয়া যায়।এতে  অনেক ছাত্রীই বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত খরচে বাইরে থেকে খাবার খায়। খরচ মেটাতে না পেরে অনেকে আবার দুইবেলার জায়গায় এক বেলাই খাচ্ছে বাধ্য হয়ে।

বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের ক্যান্টিন ম্যানেজার মো. জাহাঙ্গীর বলেন, এখন সব জিনিসের দাম বাড়তি৷ তাই পরিমাণ কমানো ছাড়া উপায় নেই৷ তবে কর্তৃপক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ভর্তুকি পেলে মূল্য ও খাবারের পরিমাণ সমম্বয় করা সম্ভব হবে।

সবকিছুর সম্মিলিত প্রভাব পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর। পরিস্থিতির মারপ্যাঁচে কম ও অপুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করছে তারা। আর কম ও অপুষ্টিকর খাবার গ্রহণের কারণে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারেন বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমার বাসা পুরান ঢাকায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে আমাদের জীবনাচরণ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছি৷ আগে ডিম-ভাত বা খিচুড়ি দিয়ে সকালের নাশতা করতাম। ইদানীং খাবারের মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় সকালের নাশতা থেকে ডিম বাদ দিয়েছি। একটু তুলনামূলক ভালো খাবার খাওয়ার সাহস হয় না। কম দামি জিনিস দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছি। এতে ধীরে ধীরে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। টাকা বাঁচাবো নাকি নিজেকে বাঁচাবো এটাই বুঝে উঠতে পারছিনা।

এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে রাতের খাবারের সুযোগ থাকলে আর দাম আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্যোগ নিলে উপকার হতো। আমাদের এখানে খাবারেরও পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। এটা দু:খজনক।

এবিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, আসলে এখন সবকিছুর চওড়া দাম। এতে শিক্ষার্থীদের কষ্ট হচ্ছে এটা ঠিক। তবে এমনাবস্থায় শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও কিছু করার সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, ক্যান্টিনের খাবারের দামও বাড়াতে চেয়েছিল মালিক। কিন্তু আমি বার বার বলে সেটি বন্ধ রেখেছি। যেহেতু এখন সবকিছুর দাম বাড়তি তাই ক্যান্টিনের খাবারগুলোর দামও বাড়তে পারে সামান্য। কর্তৃপক্ষ ভর্তুকির বিষয়টি দেখতে পারেন।

এনবিএস/ওডে/সি