এনবিএস ডিজিটাল ডেস্ক প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৯:০৯ এএম
বই মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু—এই প্রবাদটি আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। কিন্তু আজকের ব্যস্ত জীবনে যখন মানুষ বই থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, তখনও কিছু প্রতিষ্ঠান অক্লান্ত পরিশ্রম করছে বইপ্রেমীদের জন্য জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে। এর অন্যতম উদাহরণ উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি, যা ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। উত্তরার ১০ নাম্বার সেক্টরের ১ নাম্বার রোডের ৪ নাম্বার বাসায় অবস্থিত এই লাইব্রেরি এখন শুধু বই পড়ার স্থান নয়, বরং হয়ে উঠেছে এক প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক কেন্দ্র।
এই গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ তারেকউজ্জামান খান। তাঁর স্বপ্ন ছিল উত্তরার মানুষের জন্য এমন একটি জ্ঞানের বাতিঘর তৈরি করা, যেখানে বয়স বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সবাই পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে পারবেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অপরিসীম। আর সেই স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছে উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি।
বর্তমানে লাইব্রেরিটিতে রয়েছে প্রায় ২০ হাজার বই। এখানে সাহিত্যের ক্লাসিক থেকে শুরু করে আধুনিক উপন্যাস, গবেষণাধর্মী বই, ইতিহাস, দর্শন, ইসলামী সাহিত্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সামাজিক উন্নয়ন, আত্ম-উন্নয়নমূলক বই—সবকিছুই পাওয়া যায়। শিশুদের জন্য রয়েছে রূপকথা, ছড়া-কবিতা ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনি, শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের বাইরের নানা বই, আর বড়দের জন্য সমৃদ্ধ সাহিত্য ও গবেষণার ভাণ্ডার।
লাইব্রেরি প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রতিদিন গড়ে ৬০-৭০ জন পাঠক এখানে আসেন। পাঠকদের সুবিধার্থে রয়েছে ৫০টি আসন, সিসি ক্যামেরা নিরাপত্তা, এমনকি আইপিএস সুবিধাও, যাতে বিদ্যুৎ চলে গেলেও পাঠ কার্যক্রম বন্ধ না হয়।
গ্রন্থাগারকে বলা হয় "জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়"। কারণ এখানে অর্থনৈতিক, সামাজিক বা বয়সগত কোনো বিভেদ নেই। উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি এই ধারণাকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছে। এটি কেবল বই পড়ার স্থান নয়, বরং জ্ঞান ও সংস্কৃতির মিলনমেলা। পাঠকরা এখানে শান্ত পরিবেশে বই পড়ার পাশাপাশি নিজেদের চিন্তাভাবনা সমৃদ্ধ করতে পারেন।
উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি কিছু স্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে—
শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, নানা ধরনের বইয়ের মাধ্যমে জীবনব্যাপী শিক্ষাকে উৎসাহিত করা।
তরুণদের অপসংস্কৃতি থেকে দূরে রেখে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চায় আগ্রহী করা।
শিশু-কিশোরদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা।
সমাজ সচেতন, দায়িত্বশীল ও জ্ঞানপিপাসু নাগরিক তৈরি করা।
উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি শুধু বই পড়ার জায়গা নয়, সমাজের প্রতিও দায়িত্ব পালন করছে। প্রতি বছর তারা গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করে। পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থী সংবর্ধনা, মুক্তিযোদ্ধা ও হাফেজে কোরআনের সম্মাননা, রত্নগর্ভা মা ও গর্বিত বাবাকে সম্মাননা, এমনকি সেরা শিক্ষক ও গুণী সাহিত্যিকদেরও সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এসব আয়োজন কেবল উৎসাহ জোগায় না, বরং সমাজে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেয়।
ডিজিটাল যুগে তাল মিলিয়ে লাইব্রেরি এখন আরও আধুনিক হওয়ার পথে। ভবিষ্যতে এখানে ডিজিটাল লাইব্রেরি সেবা, অনলাইন বুক রিজার্ভেশন, এমনকি ই-বুক সেবাও চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। এর ফলে শুধু উত্তরার বাসিন্দারাই নয়, দেশের যেকোনো জায়গা থেকে মানুষ উপকৃত হতে পারবেন।
এই লাইব্রেরির পরিবেশ এতোটাই শান্তিপূর্ণ ও মনোমুগ্ধকর যে পাঠকরা শুধু জ্ঞান অর্জনের জন্যই আসেন না, বরং মানসিক প্রশান্তির জন্যও এখানে সময় কাটান। বইয়ের সাথে নিরিবিলি সময় কাটানো আজকের ব্যস্ত জীবনে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি আজ সত্যিই হয়ে উঠেছে বইপ্রেমীদের অভয়াশ্রম। যেখানে বইয়ের কদর কমে যাচ্ছে, সেখানে এই লাইব্রেরি এক নিঃশব্দ বিপ্লব চালাচ্ছে। বইপ্রেমী, জ্ঞানপিপাসু এবং সৃজনশীল প্রজন্ম গড়ার মাধ্যমে এটি উত্তরার মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে।
এক কথায়, উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি শুধু একটি ভবন নয়, এটি উত্তরার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। বইয়ের আলোয় মানুষকে আলোকিত করা, জ্ঞানের ভাণ্ডার সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত করার এই নিরন্তর প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।