এনবিএস ওয়েবডেস্ক প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৭:০৯ পিএম
ভারতের এক গর্ভবতী নারীকে "অবৈধ বাংলাদেশি" সন্দেহে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার ঘটনা আইনবিরোধী ছিল—এমনই রায় দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। এই রায়ে শুধু ওই নারীই নন, তার সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠানো আরও পাঁচজন ভারতীয়কেও চার সপ্তাহের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী ও ঋতব্রত মিত্রর বেঞ্চের এই নির্দেশকে মানবাধিকার কর্মীরা "মাইলফলক" বলে আখ্যা দিয়েছেন।
গর্ভবতী নারীটির নাম সোনালি খাতুন। দিল্লি পুলিশ তাকে তার স্বামী ও সন্তানসহ আটক করে। একই সঙ্গে আরেকটি পরিবারের তিনজন সদস্যকেও আটক করা হয়। মোট ছয়জনকে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার পুলিশ দ্রুতই নথি জোগাড় করে প্রমাণ করে যে তারা সকলে ভারতীয় নাগরিক। তবুও মাত্র দুদিনের মধ্যেই তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে আসার পর তারা কিছুদিন অবস্থান করেন। পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে এবং বর্তমানে তারা জেলার কারাগারে বন্দি আছেন।
কলকাতা হাইকোর্টের মতে, সোনালি খাতুনসহ ছয়জনকে আটক করাটাই ছিল বেআইনি। আদালত বলেছে, বিদেশি আইন অনুযায়ী সন্দেহভাজন বিদেশিকে নিজের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হয় ঠিকই, তবে প্রশাসনেরও কিছু প্রাথমিক তথ্য বা প্রমাণ থাকা জরুরি। "কারও দরজায় কড়া নেড়ে বলে দেওয়া যাবে না যে তিনি বিদেশি," এমন মন্তব্যও করেছেন বিচারপতিরা।
রায়ে আরও বলা হয়েছে, দিল্লি পুলিশ অতি তাড়াহুড়ো করে বড় ভুল করেছে। বীরভূম থানার পাঠানো পরিচয় যাচাইয়ের নথি দিল্লিতে পৌঁছায় ১০ জুলাই, অথচ ২৬ জুনেই তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। আদালত এই ঘটনার কঠোর সমালোচনা করেছে।
সোনালি খাতুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ১৯৯৮ সালের দিকে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু আদালতে প্রমাণ হিসেবে দেখানো হয় তার আধার কার্ড ও প্যান কার্ডে জন্মসাল লেখা আছে ২০০০। অর্থাৎ তিনি ১৯৯৮ সালে ভারতে প্রবেশ করার মতো বয়সীই ছিলেন না।
বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলে এখন আটক ছয়জনের মধ্যে সোনালি, তার স্বামী দানেশ শেখ এবং ছেলে সাবির শেখ বীরভূমের পাইকর থানার বাসিন্দা। অন্য পরিবারটির সদস্য সুইটি বিবি ও তার দুই ছেলে কুরবান শেখ (১৬) এবং ইমাম শেখ (৬) বীরভূমেরই ধিতোরা গ্রামের।
এদের আটক করে দিল্লির রোহিনীর কেএন কাটজু মার্গ থানার পুলিশ। পরে ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস (FRRO) জানায়, তারা বাংলাদেশি এবং তাদের ঠিকানা নাকি বাগেরহাট। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ জমির দলিলসহ একাধিক পুরোনো নথি সংগ্রহ করে প্রমাণ দেয় যে তাদের পূর্বপুরুষরাও ভারতের নাগরিক।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই রায় ভবিষ্যতে অনেককে অন্যায়ভাবে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা কমাবে। পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান ও তৃণমূল কংগ্রেস এমপি সামিরুল ইসলাম বলেছেন, "কেবল বাংলায় কথা বললেই অন্য রাজ্যে গিয়ে মানুষকে বাংলাদেশি সন্দেহ করা হচ্ছে। এই রায় সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের জয়।"
পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আসিফ ফারুকও মনে করেন, ভিন রাজ্যে কাজ করা পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষায় এই রায় এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত।
গত চার মাস ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অবৈধ বাংলাদেশি চিহ্নিত করার নামে বিশেষ অভিযান চলছে। এর মধ্যে অনেক বৈধ ভারতীয় নাগরিককেও সন্দেহ করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অন্তত ১৫ জনকে পরে দেশে ফিরিয়ে আনা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মামলা হয়নি। তাই সোনালি খাতুন ও তার পরিবারের মামলাকে মানবাধিকারকর্মীরা "মাইলফলক রায়" বলে বর্ণনা করছেন।
সোনালি খাতুন ও তার পরিবারের ঘটনা কেবল একটি মামলা নয়, বরং নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারের প্রশ্নে ভারতের বিচারব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদালতের নির্দেশে এখন সবার চোখ চার সপ্তাহের মধ্যে তাদের ভারতে প্রত্যাবর্তনের দিকে।