ঢাকা, শনিবার, অক্টোবর ৪, ২০২৫ | ১৯ আশ্বিন ১৪৩২
Logo
logo

ঈমান পূর্ণ হয় পরোপকার ও ভ্রাতৃত্বে


এনবিএস ওয়েবডেস্ক   প্রকাশিত:  ০৪ অক্টোবর, ২০২৫, ০৫:১০ পিএম

ঈমান পূর্ণ হয় পরোপকার ও ভ্রাতৃত্বে

  নিচের হাদিসটি ইসলামের এক মহান নৈতিক নীতি ও মানবসম্পর্কের ভিত্তিমূল শিক্ষা বহন করে। এটি ইসলামী আদর্শ সমাজ গঠনের অন্যতম ভিত্তি। যেখানে ঈমান, ভালোবাসা, পরোপকার ও ভ্রাতৃত্ব একত্রে মিলিত হয়-

عَنْ أَنَسٍ ـ رضى الله عنه ـ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم‏. قَالَ ‏ "لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ‏"‏‏.

আনাস (রাযি.) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমাদের কেউ প্রকৃত মু‘মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেটাই পছন্দ করবে, যা তার নিজের জন্য পছন্দ করে।(বুখারি, হাদিস : ১৩)

এখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রকৃত ঈমানের মানদণ্ড তুলে ধরেছেন। “ لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ”  অর্থাৎ, তোমাদের কারো ঈমান পূর্ণাঙ্গ বা পরিপূর্ণ হবে না, যতক্ষণ না তার হৃদয়ে এমন এক আন্তরিকতা জন্ম নেয়, যে সে নিজের জন্য যা চায়, তা-ই তার মুসলিম ভাইয়ের জন্যও চায়। এটি ঈমানের সৌন্দর্যকে সামাজিক ও মানবিক বাস্তবতায় রূপ দেয়। সত্যিকারের মুমিন কখনো আত্মকেন্দ্রিক হতে পারে না; বরং তার মন সবসময় অন্যের মঙ্গলের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

হাদিসে “ভাই” শব্দের অর্থ

হাদিসে “لِأَخِيهِ” অর্থাৎ “তার ভাইয়ের জন্য” এখানে “ভাই” বলতে মূলত ধর্মীয় ভাই (মুসলিম ভাই) বোঝানো হয়েছে। তবে আলেমগণ বলেছেন, ইসলামের দৃষ্টিতে এই নীতি মানবতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ, একজন প্রকৃত মুসলিম অন্য যে কারও জন্যও ন্যায়, কল্যাণ, শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করবে, যেমনটা সে নিজের জন্য চায়। ইবনে হাজার আল-আসকালানী (রহ.) বলেন: “এই হাদিসটি মানুষের পারস্পরিক আচরণের সারকথা। এটি পরিপূর্ণ নৈতিকতা ও সামাজিক ন্যায়বোধের ভিত্তি।” (ফাতহুল বারী, খণ্ড ১, পৃ. ৫৮) “নিজের জন্য যা পছন্দ করে”—এর অর্থ

এর অর্থ শুধুমাত্র জাগতিক সুবিধা নয়; বরং দ্বীনি ও আখিরাতের মঙ্গলকেও অন্তর্ভুক্ত করে। একজন প্রকৃত মুমিন চাইবে তার ভাই যেনও ঈমানদার, সৎ ও সফল হয়, সে যেন গুনাহ থেকে বাঁচে, আল্লাহর রহমত লাভ করে, যেমনটা সে নিজের জন্য কামনা করে। ইমাম নববী (রহ.) বলেন: “এই ভালোবাসা মানে এমন যে, সে চায় অন্য মুসলিমরা আল্লাহর আনুগত্যে, রিজিক ও সুখে সফল হোক। আর যদি নিজের জন্য দ্বীনি উন্নতি ভালোবাসে, তবে তার ভাইয়ের জন্যও একই কামনা করবে। ” (শরহ্‌ সহিহ মুসলিম, খণ্ড ২)

আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে পরোপকারিতায় রূপান্তর

এই হাদিস মুসলিম সমাজকে স্বার্থপরতা থেকে পরোপকারে, হিংসা থেকে ভালোবাসায়, অন্যায় থেকে ন্যায়ে রূপান্তরিত করতে শেখায়। কারণ, যে ব্যক্তি নিজের জন্য ভালো চায় কিন্তু অন্যের ক্ষতি কামনা করে তার ঈমান এখনো অপূর্ণ। যার মনে হিংসা, প্রতিযোগিতা, ঘৃণা সে ঈমানের পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেনঃ “তারা নিজেদের ওপরে অন্যদের অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা নিজেরাই অভাবগ্রস্ত।” (সুরা আল-হাশর, আয়াত : ৯) এই আয়াত ও হাদিস একে অপরের পরিপূরক— যেখানে মুসলিম সমাজের মূলনীতি হলো ‘ইসার’ (পরার্থপরতা)।

হাদিসের নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষা

এই হাদিসের শিক্ষা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং এটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নীতিতেও প্রযোজ্য। ইসলামী দৃষ্টিতে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে, প্রত্যেকে অন্যের অধিকারের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও সদাচরণ ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পথ হলো মানবকল্যাণ।

আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে

বর্তমান মনোবিজ্ঞানে বলা হয়, “Empathy” অর্থাৎ অন্যের অনুভূতি বোঝা মানবসম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা.) এই নীতিটি ১৪০০ বছর আগেই ঈমানের শর্ত হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

নবী জীবনে হাদিসের পরিপূরক উদাহরণ

রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ জীবনে এই হাদিসের জীবন্ত দৃষ্টান্ত রেখেছেন। যেমন—

তিনি কখনো নিজের জন্য বিলাসিতা চাননি, বরং অন্যের প্রয়োজনে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। সাহাবীগণও এই শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের খাদ্য, বস্ত্র ও সম্পদ ভাইদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। একবার এক সাহাবী অতিথির আপ্যায়নে নিজের খাবার পরিবারসহ ভাগ করে দেন, অথচ নিজে অনাহারে থাকেন। এ নিয়ে পবিত্র কোরআনে আয়াত নাজিল হয়: “তারা নিজেদের ওপর অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা নিজেরাই অভাবগ্রস্ত।” (সূরা হাশর, আয়াত : ৯) এটাই প্রকৃত ঈমানের বহিঃপ্রকাশ; যা এই হাদিসের মর্মার্থ।

ঈমানের পরিপূর্ণতা ও আত্মশুদ্ধি

এই হাদিস আত্মশুদ্ধি (তাযকিয়া) ও আখলাকের মূল ভিত্তি। ঈমান শুধু মুখের কথা নয়; বরং অন্তরের আমল, অনুভূতি ও আচরণের সমন্বয়। যে ব্যক্তি নিজের জন্য ভালোবাসে আর অন্যের জন্য ঘৃণা করে—তার ঈমান অসম্পূর্ণ। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেন: “যতক্ষণ না মানুষ নিজের ভাইয়ের দুঃখে দুঃখী হয়, ততক্ষণ তার অন্তর ঈমানের আলোতে পূর্ণ হয় না।”

এই হাদীস আমাদের শেখায়—

 প্রকৃত ঈমান মানে পরের সুখে আনন্দ পাওয়া, পরের কষ্টে দুঃখিত হওয়া।

 আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা ঈমানের পরিপূর্ণতায় বাধা।

 ঈমানের সৌন্দর্য প্রকাশ পায় মানবিকতা ও ভ্রাতৃত্বে।

তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত— নিজের জীবনে এই হাদিসের শিক্ষাকে ধারণ করা; অন্যের জন্য কল্যাণ কামনা করা;  আর সেই সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে মানুষ পরস্পরের জন্য দোয়া ও ভালোবাসায় নিবেদিত থাকবে।