এনবিএস ওয়েবডেস্ক প্রকাশিত: ০৪ অক্টোবর, ২০২৫, ০৭:১০ পিএম
বাংলাদেশের সাবেক ‘মিস আর্থ বাংলাদেশ’ ও সমাজকর্মী মেঘনা আলমের জীবন হঠাৎ বদলে যায় এক কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে। সউদী আরবের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ঈসা ইউসুফ আল দুহাইলান সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র প্রেমঘটিত সম্পর্ক শুধু সমালোচনায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং পরিণত হয়েছে জাতীয় ও কূটনৈতিক কেলেঙ্কারিতে।
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে, যেখানে প্রথমবারের মতো মেঘনার সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের পরিচয় হয়। শুরুতে সৌজন্য এবং উপহার বিনিময়ের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তবে দ্রুত তা প্রেমের ঝড়ো রূপ নেয়। সম্পর্ক ঘিরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে—গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের বিষয়টি সমাজে তোলপাড় সৃষ্টি করে।
২০২৫ সালের ৯ এপ্রিল, রাষ্ট্রদূতের অভিযোগের ভিত্তিতে মেঘনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগ ছিল, তিনি রাষ্ট্রদূতকে ‘হানিট্র্যাপ’-এ ফেলে অর্থ আদায় করতে চেয়েছেন, যা বাংলাদেশ-সউদী সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
মেঘনা আলম ২০২০ সালে মিস আর্থ বাংলাদেশ খেতাব জিতে জাতীয় পরিচিতি পান। বর্তমানে তিনি মিস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রশিক্ষক। তিনি জানান, রাষ্ট্রদূত প্রথমে তাকে কুরআন শরিফ, নামাজের চাদর ও প্রার্থনার পোশাক উপহার দেন। এরপর আসতে থাকে ফুল, গয়না এবং এমনকি ২০০ কেজি খেজুর, যার গায়ে লেখা ছিল “সউদী বাদশাহর উপহার”। প্রথমে দ্বিধা থাকলেও ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হন মেঘনা।
রাষ্ট্রদূত তাকে হীরের আংটি উপহার দেন এবং দাবি করেন তিনি বিবাহবিচ্ছিন্ন। তবে সতর্ক করে দেন, সউদী কূটনীতিকদের বাংলাদেশি নারীকে বিয়ে করার অনুমতি নেই। এদিকে, গুজব ছড়াতে থাকে যে মেঘনা গর্ভবতী হয়ে গোপনে গর্ভপাত করেছেন। মুসলিম সমাজে এই বিষয় নিষিদ্ধ হওয়ায় তার ইমেজে বড় ধাক্কা লাগে, অনেক ব্র্যান্ড চুক্তি বাতিল করে।
একপর্যায়ে একজন নারী ফোন করে নিজেকে রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী দাবি করেন। তিনি মেঘনাকে জাতিগতভাবে অপমান করেন এবং বলেন, “সে কখনো তার বন্ধুদের কাছে স্বীকার করবে না যে সে এক ‘বাংলালী’কে ভালোবাসে।” এতে মেঘনা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে অধিকাংশ উপহার ফেরত দেন, শুধু কুরআন, নামাজের চাদর ও ধর্মীয় কিছু উপহার রেখে দেন।
পরের দিন, ৯ এপ্রিল, সাদা পোশাকের কিছু লোক তার বাসায় হাজির হয় জন্মসনদ ও মাদকের অজুহাত তুলে। আতঙ্কিত মেঘনা ফেসবুকে লাইভ আসে। এরপর তাকে আটক করে গোপন স্থানে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে ফোন ও ল্যাপটপ কেড়ে নিয়ে তাকে লাইভ ভিডিও মুছে ফেলতে বাধ্য করা হয়। পরে তাকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। অভিযোগ ছাড়াই গ্রেপ্তার করে দিন কয়েক পর প্রতারণা, চাঁদাবাজি ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থহানির মামলা করা হয়।
পুলিশ দাবি করে, ব্যবসায়ী দেওয়ান সামিরসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলে মেঘনা কূটনীতিক ও ধনী ব্যবসায়ীদের ফাঁদে ফেলতেন। ১০ এপ্রিল আদালত বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের হেফাজত দেন। পরদিন বলা হয়, তিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও বিদেশি সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। তবে ২৮ এপ্রিল তিনি জামিন পান। এই সময় সামাজিক মাধ্যমে তার পুরোনো ছবি ছড়িয়ে তাকে ‘বিদেশি এজেন্ট’ হিসেবে অপমান করা হয়।
২৭ জন নারী অধিকারকর্মী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে চিঠি লিখে মেঘনার মুক্তি দাবি করেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, “স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট” আইনটি ভয়ঙ্কর এবং স্বেচ্ছাচারীভাবে আটক রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়। তারা মেঘনার মুক্তি অথবা বৈধ অভিযোগ আনার আহ্বান জানায়।
মেঘনা আলম জানিয়েছেন, তাকে গ্রেপ্তারের দিনই রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ ছাড়েন এবং সামাজিক মাধ্যমে উপস্থিতি মুছে ফেলেন। বর্তমানে মেঘনা বাবা-মায়ের কাছে থাকছেন। নিজের ফ্ল্যাট ছাড়তে হয়েছে হয়রানির কারণে। তিনি নিয়মিত আদালতে যাচ্ছেন এবং মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।