এনবিএস ওয়েবডেস্ক প্রকাশিত: ০৮ অক্টোবর, ২০২৫, ০৩:১০ পিএম
এক দশক আগে, বিহারের কিষাণগঞ্জ জেলার একটি সরকারি স্কুলে পড়তেন মুখতার আলম। তখন তার হিন্দু সহপাঠীদের সঙ্গে ছিল দারুণ বন্ধুত্ব। বন্ধুদের সঙ্গে পড়াশোনা, প্রজেক্ট—সবই একসাথে করতেন তিনি। এমনকি বন্ধুদের অস্বস্তি না হয়, তাই একসাথে খাওয়ার সময় মাংসও এড়িয়ে চলতেন।
কিন্তু দুই বছর আগে ঘটে এক ঘটনা, যা তাদের সেই বন্ধুত্বে চিরস্থায়ী ফাটল ধরায়।
বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপির মিত্র জিতনরাম মাঝি এক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, কিষাণগঞ্জসহ পূর্ব ভারতের শেরশাহবাদী মুসলমানরা আসলে “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী”। এই মুসলমানরা মূলত বাংলা ভাষায় কথা বলেন এবং তাদের ৯১ শতাংশেরও বেশি জনগোষ্ঠী মুসলিম।
‘শেরশাহবাদী’ নামটি এসেছে ঐতিহাসিক শেরশাহবাদ অঞ্চল থেকে, যা বর্তমান বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু এলাকা জুড়ে ছিল। ধারণা করা হয়, নামটি এসেছে আফগান শাসক শেরশাহ সুরির নাম থেকে—যিনি মুঘলদের পরাজিত করে একসময় বিহার ও বাংলায় রাজত্ব করেছিলেন।
এই অঞ্চলের মুসলমানরা বাংলার এক বিশেষ উপভাষায় কথা বলেন, যেখানে উর্দু ও হিন্দি শব্দের মিশ্রণ আছে। স্থানীয়ভাবে তাদের “বাদিয়া” বা “ভাটিয়া” বলেও ডাকা হয়। ইতিহাস বলছে, তারা একসময় গঙ্গা নদীর উজানে পশ্চিমবঙ্গের মালদা-মুর্শিদাবাদ অঞ্চল থেকে সীমান্তবর্তী বিহারে এসে বসতি গড়ে তোলে।
“ওই বক্তৃতা শুনে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম,” বলেন মুখতার আলম, যিনি এখন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় চালান। আতঙ্ক পেরিয়ে আলম প্রতিবাদে ফেসবুকে পোস্ট দেন। কিন্তু তারই এক প্রিয় বন্ধু হিন্দিতে মন্তব্য করে বসেন—“তোমরা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী!”
“ওই মন্তব্যটা পড়েই শরীর শিউরে উঠেছিল,” বলেন আলম। “ওই মুহূর্তে বুঝেছিলাম, আমরা বিশ্বাস হারিয়েছি—ভ্রাতৃত্ব হারিয়েছি।”
সরকারি তথ্যমতে, আলম হচ্ছেন বিহারের প্রায় ১৩ লাখ শেরশাহবাদী মুসলমানের একজন, যাদের বেশিরভাগ কিষাণগঞ্জ ও কাটিহার জেলায় বসবাস করেন।
বিহার এখন গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য নির্বাচনকে সামনে রেখে উত্তপ্ত রাজনীতির কেন্দ্রে। বিজেপি ও তার মিত্ররা “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” ইস্যুকে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে—বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান এই সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে।
গত ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি “উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যাতাত্ত্বিক মিশন” গঠনের ঘোষণা দেন। তার দাবি, “কোনও দেশ অনুপ্রবেশকারীদের হাতে নিজেকে তুলে দিতে পারে না… ভারতও দেবে না।” যদিও তিনি কারা এই অনুপ্রবেশকারী, তা স্পষ্ট করেননি।
হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর মতে, “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” বলতে বোঝানো হয় মূলত বাংলাভাষী মুসলমানদের—বিশেষ করে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষদের।
আসামে বিজেপি সরকার ইতিমধ্যেই বাংলাভাষী মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে, তাদের “বহিরাগত” আখ্যা দিয়ে। সেখানে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ—ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।
ভারতের ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, বিহারে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ—মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে কিষাণগঞ্জ, কাটিহার, আরারিয়া ও পূর্ণিয়া জেলার “সীমাঞ্চল” এলাকায় মুসলমানদের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকা পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তঘেঁষা—বাংলাদেশের সীমান্ত থেকেও কয়েক কিলোমিটারের দূরত্বে।
বিহারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৬ ও ১১ নভেম্বর, আর ফলাফল ঘোষণা করা হবে ১৪ নভেম্বর। কিন্তু ভোটের আগেই “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” বিতর্কে যেন আগুন জ্বলছে রাজনীতির মাটিতে—আর সেই আগুনে পুড়ছে সমাজের শান্ত সহাবস্থানের বন্ধন।