ঢাকা, শুক্রবার, অক্টোবর ১০, ২০২৫ | ২৫ আশ্বিন ১৪৩২
Logo
logo

আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলে নজিরবিহীন অস্থিরতা: নতুন নিয়মে চাপ, আমেরিকার কঠোর বিরোধিতা


এনবিএস ওয়েবডেস্ক   প্রকাশিত:  ১০ অক্টোবর, ২০২৫, ০২:১০ পিএম

আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলে নজিরবিহীন অস্থিরতা: নতুন নিয়মে চাপ, আমেরিকার কঠোর বিরোধিতা

বিশ্বজুড়ে জাহাজ চলাচল এখন বড় এক সংকটের মুখে। জাতিসংঘের নেট-জিরো উদ্যোগ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহন সংস্থা (IMO)-এর নতুন পরিবেশবিধির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এতে বৈশ্বিক শিপিং শিল্পে অস্থিরতা বাড়ছে।

নতুন জলবায়ু নীতিতে বিভাজন
আগামী ১৪-১৭ অক্টোবর IMO-এর বৈঠকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর নতুন নিয়ম অনুমোদনের কথা ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আগস্টে ঘোষণা দেয়—তারা এই নিয়মের বিরোধিতা করছে এবং অন্যান্য দেশকে এটি প্রত্যাখ্যান করতে আহ্বান জানায়। না মানলে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়ারও হুমকি দিয়েছে তারা।

ওয়াশিংটনের দাবি, এই নীতিগুলো আসলে “জাতিসংঘের একটি জবাবদিহিহীন সংস্থা কর্তৃক আমেরিকার ওপর চাপানো বৈশ্বিক কার্বন কর।” এতে জ্বালানি খরচ বেড়ে যাবে এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) ও বায়োফুয়েলকে বাদ দিয়ে বিকল্প জ্বালানি যেমন অ্যামোনিয়া ও মিথানল ব্যবহারে বাধ্য করা হবে—যা চীনের জন্য লাভজনক।

আমেরিকার হুঁশিয়ারি ও সম্ভাব্য প্রতিশোধ
মার্কিন প্রশাসন স্পষ্ট করে দিয়েছে—“আমাদের নাগরিক ও কোম্পানির ওপর খরচ বাড়ানো কোনো সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নেব না।” প্রয়োজনে শুল্ক, ভিসা নিষেধাজ্ঞা বা বন্দর ফি বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে তারা।

তবুও, IMO-এর আগের ভোটে দেখা গেছে—৬৩টি দেশ নতুন নিয়মের পক্ষে, ১৬টি বিপক্ষে এবং ২৪টি বিরত ছিল। তবে এই সমর্থন মোট সদস্য দেশের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। অক্টোবরের বৈঠকে যদি আরও দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যায়, তাহলে নিয়মটি আটকে যেতে পারে।

নতুন নিয়ম কী বলছে?
এই প্রস্তাব অনুযায়ী, ৫ হাজার টনের বেশি ওজনের জাহাজগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে নির্দিষ্ট জ্বালানি মান পূরণ করতে হবে। নির্ধারিত সীমার বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করলে প্রতি টনে ১০০ থেকে ৩৮০ ডলার পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে। এই অর্থ জমা হবে “IMO Net-Zero Fund”-এ, যা ব্যবহার হবে কম নির্গমন প্রযুক্তি ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সহায়তায়।

IMO-এর হিসাব অনুযায়ী, নতুন নিয়ম কার্যকর হলে জাহাজ চলাচল থেকে নির্গমন ৪০% পর্যন্ত কমতে পারে, যা বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় ১% হ্রাস করবে।

শিল্পের আশঙ্কা ও অর্থনৈতিক প্রভাব
শিপিং শিল্প বলছে, নিয়ম বাস্তবায়িত হলে ব্যয় ব্যাপকভাবে বাড়বে। কেবল জরিমানা বাবদ ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ২০-৩০ বিলিয়ন ডলার, আর ২০৩৫ সালের মধ্যে তা ৩০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে। কারণ, বর্তমানে বিশ্বের ৯০% জাহাজ প্রচলিত জ্বালানি ব্যবহার করে, যা বদলাতে বিশাল বিনিয়োগ লাগবে।

তাছাড়া, পরিবেশবান্ধব জ্বালানির দাম প্রচলিত জ্বালানির তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি। ফলে জ্বালানি ব্যয় প্রায় ৩৫০% পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর চাপ শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই পড়বে—পরিবহন ব্যয় বাড়লে পণ্যের দামও বাড়বে।

বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন দ্বন্দ্ব
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিতর্ক এখন কেবল পরিবেশ নয়, বরং ভূরাজনীতিরও বিষয় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থনের ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্পর্কেও নতুন বিভাজন তৈরি হচ্ছে।
পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে অক্টোবরের IMO বৈঠকের ওপর—যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতিগুলোর মুখোমুখি সংঘাতের ইঙ্গিত মিলছে।