এনবিএস ওয়েবডেস্ক প্রকাশিত: ০৪ নভেম্বর, ২০২৫, ০২:১১ পিএম

আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য কানাডার কঠোর নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ভারতীয় আবেদনকারীরা। এক সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় গন্তব্য হলেও, সরকারি তথ্য বলছে, ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে কানাডার সেই আকর্ষণ এখন কমছে। ২০২৫ সালের শুরুতেই টানা দ্বিতীয় বছরের মতো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী পারমিট বা ভিসার সংখ্যা কমিয়েছে কানাডা। মূলত সাময়িক অভিবাসীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনা এবং স্টুডেন্ট ভিসা জালিয়াতি ঠেকানোর জন্য এই বৃহত্তর পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি।
তিন-চতুর্থাংশ আবেদন বাতিল: চমকে দেওয়া পরিসংখ্যান
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া কানাডার অভিবাসন বিভাগের তথ্যে চোখ রাখলে দেখা যায়, ২০২৫ সালের আগস্টে ভারতীয় আবেদনকারীদের প্রায় ৭৫ শতাংশের স্টুডেন্ট ভিসা বাতিল করা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতি ৪ জন আবেদনকারীর মধ্যে ৩ জনেরই ভিসা প্রত্যাখ্যান হয়েছে!
তুলনা করলে দেখা যায়, ২০২৩ সালের আগস্টে এই প্রত্যাখ্যানের হার ছিল মাত্র ৩২ শতাংশ।
একই সময়ে সামগ্রিকভাবে সব দেশের আবেদনকারীর গড়ে ৪০ শতাংশ এবং চীনা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে মাত্র ২৪ শতাংশ আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
সরকারি পরিসংখ্যান আরও বলছে, ২০২৩ সালের আগস্টে যেখানে ২০ হাজার ৯০০ ভারতীয় শিক্ষার্থী আবেদন করেছিলেন, ২০২৫ সালের আগস্টে সেই সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ হাজার ৫১৫ জনে।
গত এক দশক ধরে কানাডায় বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রধান উৎস ছিল ভারত। অথচ এখন ভারতীয় শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ভিসা প্রত্যাখ্যানের শিকার হচ্ছেন।
geopolitics 🇨🇦🇮🇳 কূটনৈতিক টানাপোড়েন এবং জালিয়াতির কালো ছায়া
এই প্রত্যাখ্যানের ঢেউ এমন এক সময়ে এসেছে, যখন গত এক বছরের বেশি সময় ধরে কানাডা ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কে চরম টানাপোড়েন চলছে। ২০২৩ সালে কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অভিযোগ করেন, ভারতের সরকার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সারে শহরে এক কানাডিয়ান নাগরিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। যদিও ভারত বারবার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
অন্যদিকে, ভিসা জালিয়াতিও একটি বড় কারণ।
২০২৩ সালে কানাডার অভিবাসন বিভাগ প্রায় ১ হাজার ৫৫০টি জাল আবেদনপত্র শনাক্ত করে, যার বেশির ভাগই এসেছিল ভারত থেকে।
এরপর ২০২৪ সালে স্টুডেন্ট ভিসা যাচাইয়ে আরও শক্তিশালী ব্যবস্থা চালু করা হয়। ওই বছর প্রায় ১৪ হাজারের বেশি জাল আবেদনপত্র শনাক্ত হয়, যা সব দেশের আবেদনকারীদের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল।
এ কারণেই কানাডা এখন বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত যাচাইব্যবস্থা চালু করেছে এবং অর্থনৈতিক যোগ্যতার মানদণ্ডও বাড়িয়েছে।
📢 ভারতের প্রতিক্রিয়া: 'আমরাই প্রতিভার প্রধান উৎস'
অটোয়ায় ভারতীয় দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের আবেদন প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি তাদের নজরে এসেছে। তবে স্টুডেন্ট ভিসা দেওয়া বা না দেওয়া সম্পূর্ণরূপে কানাডার নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
কিন্তু দূতাবাস একই সঙ্গে বলেছে, বিশ্বের মানসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের অন্যতম প্রধান উৎস ভারত। কানাডার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অতীতে ভারতীয়দের প্রতিভা ও একাডেমিক উৎকর্ষতা থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে।
কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিতা আনন্দ গত অক্টোবরে ভারত সফরের সময় রয়টার্সকে বলেছিলেন, তাঁর সরকার অভিবাসনব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও, কানাডা চায় ভারতীয় শিক্ষার্থীরা যেন দেশটিতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেন।
প্রমাণ করতে হবে টাকার উৎস! নতুন কড়াকড়ি
শিক্ষা–ভিসা সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান বর্ডার পাসের কর্মকর্তা মাইকেল পিয়েত্রোকার্লো জানান, এখন আবেদনকারীদের ওপর আগের চেয়ে অনেক বেশি যাচাই-বাছাই চলছে। শুধুমাত্র ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখালেই হবে না, আবেদনকারীদের এখন প্রমাণ করতে হচ্ছে যে টাকার উৎস কী।
এর ফলস্বরূপ, কানাডার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত তিন থেকে চার বছরে ভারতীয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। রেজিনা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাসকাচেওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়েও ভারতীয় শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা কমেছে বলে জানা গেছে।
আন্তর্জাতিক শিখ ছাত্র সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জসপ্রীত সিংহ ২০১৫ সালে ভারত থেকে কানাডায় এসেছিলেন। তিনি বলেন, একসময় সরকার নতুনদের জন্য প্রচারণা চালাত—Study, Work, Stay (পড়ো, কাজ করো, থাকো)। কিন্তু এখন সেই মনোভাব পুরোপুরি বদলে গেছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমি জানি, প্রতারণা এখন বড় সমস্যা। তাই ভিসা প্রত্যাখ্যানের খবর শুনে অবাক হইনি। তবে কানাডায় স্থায়ীভাবে থাকা বা কাজ পাওয়া এখন এত কঠিন হয়ে গেছে যে, এটা ভেবেই এখন অনেকে খুশি।’