ঢাকা, রবিবার, নভেম্বর ৯, ২০২৫ | ২৫ কার্তিক ১৪৩২
Logo
logo

অবাস্তব স্বপ্নে ভর করে সৌদি যুবরাজের ‘দ্য লাইন’ মেগা প্রকল্পে নেমেছে বড় ধাক্কা


এনবিএস ওয়েবডেস্ক   প্রকাশিত:  ০৯ নভেম্বর, ২০২৫, ০৩:১১ পিএম

অবাস্তব স্বপ্নে ভর করে সৌদি যুবরাজের ‘দ্য লাইন’ মেগা প্রকল্পে নেমেছে বড় ধাক্কা

সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ নগর স্বপ্ন ‘দ্য লাইন’ নিয়ে এবার বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি) জানিয়েছে, স্থপতি ও প্রকৌশলীরা এই বিশাল প্রকল্পে ব্যাপক কাটছাঁট শুরু করেছেন।

১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই শহরটি লোহিত সাগরের উপকূলে গড়ে ওঠার কথা, যা সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উচ্চাভিলাষী মেগা প্রকল্প নিওম-এর মূল অংশ। কিন্তু এখন সেই পরিকল্পনাই বাস্তবায়নের পথে বড় বাধার মুখে পড়েছে।

বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না স্বপ্ন

এফটির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য ২০ জনের বেশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা যুবরাজের স্বপ্ন পূরণে চরম চ্যালেঞ্জে পড়েছেন। কারণ, পুরো পরিকল্পনাই “অবাস্তব এবং অতিমাত্রায় ব্যয়বহুল।”

একজন পরিকল্পনাকারী বলেন, যুবরাজ জোর দিয়ে জানিয়েছিলেন—‘দ্য লাইন’-এর উচ্চতা হতে হবে ৫০০ মিটার, প্রস্থ ২০০ মিটার। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, ১০০ মিটার উঁচু কাঠামোই বাস্তবসম্মত।

আরেকজন জানান, প্রকল্পের শুরুর দিকে কেউ বলেছিলেন, মাত্র ২০ মিনিটে বিমানবন্দর থেকে উপকূলে পৌঁছানো যাবে এমন দ্রুতগতির রেললাইন বানানো সম্ভব। যুবরাজ তাতে তৎক্ষণাৎ সম্মতি দেন।

প্রাথমিক পরিকল্পনায় ২০টি মডিউল নির্মাণের কথা ছিল, কিন্তু ২০২৩ সালের মধ্যে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র তিনটিতে। প্রকল্পে ইতিমধ্যে প্রায় ৫ হাজার কোটি ডলার খরচ হয়েছে, তবু তিন বছর ধরে কাজ এগোয়নি প্রত্যাশা অনুযায়ী।

একজন জ্যেষ্ঠ নির্মাণ ব্যবস্থাপক তো সরাসরি বলেন, “এই প্রকল্প বিনিয়োগযোগ্য নয়।”

যুবরাজের সিদ্ধান্তে ‘ভয়ের সংস্কৃতি’

নিওমের কর্মচারীদের মতে, যুবরাজ ক্রমবর্ধমান ব্যয় বা সময়সীমা নিয়ে কোনো উদ্বেগকেই গুরুত্ব দেননি। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ১৬ কিলোমিটার এলাকা সম্পন্ন করার কথা ছিল, এবং ২০২৫ সালেই প্রথম ধাপে বাসিন্দাদের প্রবেশ করার কথা।

কিন্তু এক পরিকল্পনাকারীর ভাষায়, “যুবরাজের জন্য নকশা প্রদর্শনের সময় চারপাশে ভয় ছড়িয়ে থাকত। তিনি যা বলতেন, সবাই চোখ বন্ধ করে তাই করত।”

উচ্ছেদ, মৃত্যুদণ্ড ও মানবাধিকার বিতর্ক

শুরুর পর থেকেই ‘দ্য লাইন’ প্রকল্প বিতর্কে জর্জরিত। স্থানীয় মানুষ উচ্ছেদ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগ তুলেছেন।

এফটির প্রতিবেদনে দুটি গ্রামের নাম উঠে এসেছে—কায়াল ও আল-খুরাইবা—যেখান থেকে জোর করে মানুষ উচ্ছেদ করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, প্রতিবাদ করায় হুয়াইতাত গোত্রের অন্তত ৫০ জনকে আটক করা হয়, তাঁদের মধ্যে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

একজন সাবেক সৌদি গোয়েন্দা কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আই–কে বলেন, বিক্ষোভ দমন করতে সরকার নিরাপত্তা বাহিনীকে “হত্যার অনুমতি” দিয়েছিল। এতে আল-মুসাওয়ারা অঞ্চলে কয়েকজন সাধারণ নাগরিক, এমনকি তিন বছরের এক শিশুও নিহত হয়।

কর্মীদের মৃত্যু ও দুর্নীতির অভিযোগ

মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রকল্পে নির্মম কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক শোষণের কথাও তুলেছে। এক নির্মাণকেন্দ্রে গার্ডরেল ধসে পাকিস্তানি প্রকৌশলী আবদুল ওয়ালি ইস্কান্দার খান নিহত হন, কিন্তু সৌদি কর্তৃপক্ষ এ ঘটনার যথাযথ তদন্ত বা ক্ষতিপূরণ দেয়নি।

এর আগে প্রকল্পের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ, নারীবিদ্বেষ ও দুর্নীতির অভিযোগও ওঠে।

নতুন বিনিয়োগ নীতিতে পরিবর্তন

রয়টার্স-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি সরকার তাদের ৯২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের সার্বভৌম তহবিলের বিনিয়োগ কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনছে। নিওমের মতো বিশাল রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের বদলে এখন লজিস্টিকস, খনিজ সম্পদ, ধর্মীয় পর্যটন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা সেন্টারের মতো খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার।

গত জুলাইয়ে নিওম প্রায় এক হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের কথাও জানায়, যা মোট কর্মীর প্রায় ২০ শতাংশ। সব মিলিয়ে পরিষ্কার ইঙ্গিত—সৌদি সরকার ‘দ্য লাইন’ প্রকল্পে গতি কমাচ্ছে।