ঢাকা, সোমবার, নভেম্বর ১০, ২০২৫ | ২৬ কার্তিক ১৪৩২
Logo
logo

ইসরায়েলের ‘গোপন কসাইখানা’ রাকেফেত: মাটির নিচে বন্দীরা দেখেন না আলো, পান না খাবার!


এনবিএস ওয়েবডেস্ক   প্রকাশিত:  ১০ নভেম্বর, ২০২৫, ১১:১১ এএম

ইসরায়েলের ‘গোপন কসাইখানা’ রাকেফেত: মাটির নিচে বন্দীরা দেখেন না আলো, পান না খাবার!

 সূর্যের আলোহীন এক গোপন নরক!
গাজা যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগার থেকে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়া হলেও, মাটির নিচে একটি গোপন কারাগারে এখনো ডজন ডজন ফিলিস্তিনিকে আটকে রাখা হয়েছে। এই কারাগারটির নাম ‘রাকেফেত’ (Rakefet)। এখানে বন্দীরা কখনো সূর্যের আলো দেখতে পান না, পর্যাপ্ত খাবারও পান না। পরিবার বা বাইরের পৃথিবীর কোনো খবরও তাঁদের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ নেই।

এই কারাগারে আটক বন্দীদের মধ্যে অন্তত দুজন ছিলেন সাধারণ নাগরিক— যাদের মাসের পর মাস কোনো অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই আটকে রাখা হয়েছে। এদের একজন ছিলেন একজন পুরুষ নার্স, যাকে হাসপাতালের পোশাক পরা অবস্থায় আটক করা হয়। অন্যজন ছিলেন একজন তরুণ খাবার বিক্রেতা। আইনি সহায়তা দানকারী প্রতিষ্ঠান পাবলিক কমিটি এগেইনস্ট টর্চার ইন ইসরায়েলের (PCATI) আইনজীবীরা তাঁদের পক্ষে আইনি লড়াই করছেন।

গত জানুয়ারিতে আটক হওয়া এই দুই ব্যক্তিকে ভূগর্ভস্থ রাকেফেত কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তাঁরা নিজেদের ওপর হওয়া সহিংস আচরণ এবং নিয়মিত মারধরের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন।

 যে কারাগার একসময় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল
রাকেফেত কারাগারটি মূলত ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে ইসরায়েলের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অপরাধীদের আটক রাখার জন্য চালু করা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই এটিকে 'অমানবিক' আখ্যা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের কট্টরপন্থী নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির এই কারাগারটি পুনরায় চালু করার নির্দেশ দেন।

কারাকক্ষ, ব্যায়ামের জায়গা এমনকি আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কক্ষ— সবই এই কারাগারে মাটির নিচে অবস্থিত। ফলে এখানকার বন্দীদের প্রকৃতির আলো ছাড়াই বেঁচে থাকতে হয়।

PCATI-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে অল্প কিছু কঠোর নিরাপত্তা প্রয়োজন এমন বন্দীর জন্য এটি তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে যখন এটি বন্ধ হয়, তখন সেখানে ১৫ জন বন্দী ছিলেন। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এখানে আনুমানিক ১০০ জন বন্দীকে রাখা হয়েছে।

নার্স-খাবার বিক্রেতা থেকে হামাস জঙ্গি! কে এই বন্দীরা?
গত অক্টোবরে গাজা যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েল তাদের আদালতে দোষী সাব্যস্ত ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেয়। পাশাপাশি গাজা থেকে আটক আরও ১ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনিকে ছেড়ে দেওয়া হয়, যাদের মাসের পর মাস কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক রাখা হয়েছিল। এই মুক্তির তালিকায় রাকেফেত কারাগারে বন্দী থাকা ওই তরুণ খাবার বিক্রেতাও ছিলেন।

তবে এখনো রাকেফেতসহ ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগারে অন্তত এক হাজার ফিলিস্তিনি আটক আছেন। এর মধ্যে ওই নার্সও রয়েছেন।

PCATI বলেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শেষ হলেও গাজার ফিলিস্তিনিদের এভাবে ইসরায়েলি কারাগারে আটকে রাখা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন এবং এটি নির্যাতনের সমতুল্য।

বেন-গভির স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ৭ অক্টোবরের হামলার নেতৃত্ব দেওয়া হামাসের বিশেষ বাহিনী নুখবার সদস্য এবং হিজবুল্লাহর বিশেষ যোদ্ধাদের বন্দী রাখার জন্য রাকেফেত কারাগার আবার চালু করা হয়েছে।

তবে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, হামলাকারী কাউকে মুক্তি দেওয়া হয়নি, আর খাবার বিক্রেতা তরুণ হামলায় জড়িত না থাকায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

'আমরা কারাগারে নয়, ছিলাম কসাইখানায়'
PCATI-এর নির্বাহী পরিচালক তাল স্টেইনার বলেন, রাকেফেত কারাগারে নির্যাতনের ধরন ভিন্ন। মাটির নিচে মাসের পর মাস বন্দী থাকা মানুষগুলো সূর্যের আলোর দেখা পান না। এতে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়ে।

PCATI প্রতিষ্ঠার আগেই রাকেফেত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি ইসরায়েলি কারাগার পরিষেবার প্রধান রাফায়েল সুইসার তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ২৪ ঘণ্টা মাটির নিচে কাউকে বন্দী করে রাখা অত্যন্ত নিষ্ঠুর কাজ—তিনি যত বড় অপরাধীই হোন না কেন।

এই গ্রীষ্মে PCATI-এর আইনজীবীরা যখন প্রথম রাকেফেত কারাগারে যান, তখন তাঁদের সঙ্গে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত মুখোশ পরা নিরাপত্তারক্ষীরা ছিলেন। আইনজীবীরা সেখানে পচা পোকামাকড়ে ভরা কক্ষ এবং ব্যবহার অযোগ্য নোংরা শৌচাগার দেখেন। কারাগারের দেয়াল জুড়ে ছিল নজরদারি ক্যামেরা, যা মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন।

আইনজীবী জেনান আবদু বলেন, "আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যদি আইনজীবী হিসেবে আমাদের অবস্থাই এমন অপমানজনক হয়, তাহলে এখানকার বন্দীদের অবস্থা কেমন হতে পারে?" তিনি জানান, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বন্দীদের মাথা নিচু করে আনা হয়, প্রহরীরা জোর করে তাঁদের হেঁট করে রেখেছিলেন।

আরেক আইনজীবী সাজা মিশেরকি বারানসি জানান, ওই নার্স এবং খাবার বিক্রেতা ৯ মাস ধরে রাকেফেতে বন্দী ছিলেন। প্রহরীরা নার্সকে ওই কারাগারের নাম পর্যন্ত জানাননি!

 নির্যাতনের ভয়াবহ বিবরণ
বন্দীরা জানান, কারাগারের কক্ষগুলোতে কোনো জানালা বা বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই। একেকটি কক্ষে একসঙ্গে তিন-চারজনকে রাখা হয়। নিয়মিত শারীরিক নির্যাতন, মুখোশ পরা কুকুর দিয়ে হামলা, প্রহরীদের দিয়ে পায়ের নিচে পিষ্ট করা, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা ও প্রায়ই না খাইয়ে রাখার মতো নির্যাতনের শিকার হন বন্দীরা।

দিনের বেলা বন্দীদের কক্ষের বাইরে বের হওয়ার জন্য দেওয়া হয় নামমাত্র সময়, তাও মাটির নিচেই একটি ছোট জায়গায়। প্রায় দুই দিন পরপর মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য তাঁরা বের হতে পারতেন।

প্রতিদিন ভোর চারটার দিকে প্রহরীরা বিছানা সরিয়ে নেন।

তা ফেরত দেওয়া হয় গভীর রাতে।

এই সময়ে বন্দীদের ঘুমাতে হয় শুধুই লোহার খাটে।

বারানসি জানান, আটক ওই নার্স ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি রাকেফেত কারাগারে স্থানান্তরিত হওয়ার সময় সর্বশেষ সূর্যের আলো দেখেছিলেন। তিন সন্তানের বাবা এই নার্স আটক হওয়ার পর থেকে পরিবারের কোনো খবর পাননি।

অন্যদিকে, তরুণ খাবার বিক্রেতা তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নিরাপদে সন্তান প্রসব করতে পেরেছেন কি না, সেই খবর জানতে চেয়েছিলেন। এই প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রহরী তাঁদের কথোপকথন বন্ধ করে দেন। পরে আবদু জানতে পারেন, ওই তরুণ মুক্তি পেয়েছেন।

ইসরায়েলি গোপন নথি অনুযায়ী, যুদ্ধ চলাকালে যেসব ফিলিস্তিনিকে গাজা থেকে আটক করা হয়েছিল, তাঁদের অধিকাংশই সাধারণ নাগরিক। মানবাধিকার সংস্থাগুলো অভিযোগ করেছে, ইসরায়েল জীবিত বন্দীদেরও মৃত ফিলিস্তিনিদের মতো 'বিনিময়ের হাতিয়ার' হিসেবে ব্যবহার করছে।