এনবিএস ওয়েবডেস্ক প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর, ২০২৫, ০২:১১ পিএম

কলকাতার রাস্তায় এখন এক অদ্ভুত চিত্র। কেউ হাতে মাইক, কেউ হাতে মোবাইল—দৌড়াচ্ছেন পথে পথে, চিৎকার করে জিজ্ঞেস করছেন, “দাদা, আপনি বাংলাদেশি?” বা “কোথায় পালাচ্ছেন?” এমনই এক নারী সাংবাদিকের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তুলেছে।
শুধু তাই নয়, কিছু ইউটিউব চ্যানেল ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যম দাবি করছে, পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন বা SIR (Special Intensive Revision) শুরু হতেই ‘বাংলাদেশি রোহিঙ্গারা’ নাকি পালাতে শুরু করেছেন! কিছু ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, তালাবদ্ধ ঘরগুলো দেখিয়ে বলা হচ্ছে—এগুলোতে বাংলাদেশিরা থাকতেন, এখন তারা পালিয়েছেন।
কিন্তু এসব ভিডিওর বেশিরভাগই ভুয়া বলে প্রমাণিত হচ্ছে। বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, অনেক ক্লিপেই সাজানো দৃশ্য ব্যবহার করা হয়েছে, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই।
অনেক ইউটিউবার ও সাংবাদিক এখন রীতিমতো নাটকীয়ভাবে ‘বাংলাদেশি’ ও ‘রোহিঙ্গা’ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। কেউ মানুষের ঘরে ঢুকে প্রশ্ন করছেন—“আপনার বৈধ কাগজ আছে?” আবার কেউ তালাবদ্ধ বাড়ি দেখিয়ে দাবি করছেন—“এখানে বাংলাদেশিরা ছিল।”
সিনিয়র সাংবাদিক ও ইউটিউবারদের একাংশের মতে, এসব ভিডিও মূলত ভিউ ও আয়ের জন্য তৈরি নাটক। এতে সাংবাদিকতার নীতি নেই, বরং মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের মতে, কার নাগরিকত্ব বৈধ, কার নেই—তা যাচাই করার দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের নয়।
ভারতের সর্বভারতীয় নেটওয়ার্ক ১৮-এর ইস্ট এডিটর বিশ্ব মজুমদার বলেন,
“সংবাদ সংগ্রহ আমাদের কাজ, কিন্তু মানুষের বাড়িতে গিয়ে তাদের নথি দেখতে চাওয়া সাংবাদিকতার দায়িত্ব নয়। অনেকে যেভাবে এটা করছেন, তাদের নিজেদের সাংবাদিকতার সরকারি অনুমতিও নেই।”
“এভাবে কাজ করলে সাংবাদিকতার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যায়, যা পুরো পেশার মর্যাদার জন্য ক্ষতিকর।”
সামাজিক মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, অনেকেই বাংলাদেশি অভিবাসী ও রোহিঙ্গাদের এক করে ফেলছেন। অথচ দুই গোষ্ঠীর উৎস ও ইতিহাস সম্পূর্ণ আলাদা।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক, যারা জাতিগত নিপীড়নের কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা জাতিসংঘের পরিচয়পত্র নিয়ে ভারতে বসবাস করছে।
অন্যদিকে, ভারতের কিছু এলাকায় সত্যিই কয়েকটি বাংলাদেশি পরিবার অবৈধভাবে এসেছে—কিন্তু তাদের সবার পরিচয়কে “রোহিঙ্গা” বলে দেখানো ভুল তথ্য ছড়ানোর সমান।
কলকাতার লাগোয়া নিউ টাউন অঞ্চলের ঘূর্ণি এলাকা বর্তমানে এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানকার পুরনো বাসিন্দাদের একজন বলেন,
“এখানে সত্যিই কিছু অবৈধভাবে আসা পরিবার ছিল, কিন্তু তারা খুব অল্প সংখ্যক। কাজের খোঁজে বাইরে থাকা অনেকের ঘর তালাবদ্ধ, সাংবাদিকরা তা দেখেই বলছেন—বাংলাদেশিরা পালিয়েছে।”
এমনই এক ঘটনায়, এক নারী সাংবাদিক স্থানীয় এক ভারতীয়ের ব্যক্তিগত জমিতে ঢুকে নথি দেখতে চান, তাতেই বচসা বাধে।
অনেক ভিডিওতে দেখা গেছে, সীমান্তের লোহার গেট খুলে মানুষ বেরিয়ে আসছেন। দাবি করা হচ্ছে—“বাংলাদেশি রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে”!
কিন্তু বাস্তবে এটি বিএসএফের নিয়মিত কৃষিজমি পারাপারের সময়সূচি অনুযায়ী স্থানীয় ভারতীয় কৃষকদের যাতায়াতের ভিডিও।
“নারী ইউটিউব সাংবাদিকদের যেভাবে গালিগালাজ বা হামলা করা হচ্ছে, তা আইনশৃঙ্খলার সমস্যা। তবে এটাও ঠিক, অনেক ইউটিউবারের সাংবাদিকতার ন্যূনতম ধারণা নেই। ভিউ বাড়ানোর জন্য তারা সীমা ছাড়াচ্ছেন।”
“যে কেউ হাতে মাইক নিয়ে এখন সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছে। তথ্য যাচাইয়ের বোধটাই নেই। ফলে এরকম বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।”
বাংলাদেশি’ বা ‘রোহিঙ্গা’—এই দুই শব্দের পেছনে যে বাস্তব মানুষ আছে, তাদের সম্মান ও নিরাপত্তা নিয়েই এখন বড় প্রশ্ন। ভুয়া ভিডিও আর অযাচিত নাটক দিয়ে হয়তো কেউ সাময়িকভাবে আলোচনায় আসতে পারে, কিন্তু তাতে দুই দেশের সম্পর্কের ওপর পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব—যার দায় কেউ নিচ্ছে না।