ঢাকা, বুধবার, নভেম্বর ১৯, ২০২৫ | ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
Logo
logo

ডলারকে ঘিরে বৈশ্বিক টানাপোড়েন: আধিপত্য কমলেও কেন একই সুরে আমেরিকা-ব্রিকস?


এনবিএস ওয়েবডেস্ক   প্রকাশিত:  ১৮ নভেম্বর, ২০২৫, ০৫:১১ পিএম

ডলারকে ঘিরে বৈশ্বিক টানাপোড়েন: আধিপত্য কমলেও কেন একই সুরে আমেরিকা-ব্রিকস?

আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে ডলারের আধিপত্য কমে যাওয়ার প্রশ্নে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ডলারের বিকল্প খুঁজতে থাকা উদীয়মান ব্রিকস জোট আর এই প্রক্রিয়া ঠেকাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র—কিন্তু দুই পক্ষই এখন আশ্চর্যভাবে একই ধরনের ব্যাখ্যা দিচ্ছে। তাদের মতে, দেশগুলো ডলার থেকে সরে যাচ্ছে মূলত ওয়াশিংটনের মুদ্রাকে “অস্ত্র” হিসেবে ব্যবহার করার কারণে।

২০২২ সালে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা হলো সেই টার্নিং পয়েন্ট। তখন যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক ডলার ব্যবস্থার তত্ত্বাবধায়ক ভূমিকা ছাড়িয়ে এটিকে সরাসরি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। যদিও ঘটনা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক, প্রশ্ন হলো—শুধু এই কারণেই কি দেশগুলো ডলারের বিকল্প খুঁজতে এত ব্যস্ত?

ধারণা হলো—ওয়াশিংটনের বিরাগভাজন হলেই যেকোনো দেশ এমন নিষেধাজ্ঞার শিকার হতে পারে। কিন্তু খুব কম লোকই ভাবছে—চীনের মতো সুবৃহৎ কেন্দ্রীভূত অর্থনীতি কি রাশিয়ার মতো নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিতে বাস্তবিকই আছে?

আসলে ডলার-বিমুখতার আসল চালিকা শক্তি রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা দেশটিকে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রকৃত সুদের হার বজায় রাখতে বাধ্য করছে। রিজার্ভ হিসেবে ডলার ধরে রাখা দেশগুলোর জন্য এর অর্থ—সময়ের সাথে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে ডলার থেকে সরে যাওয়া এখন শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বিনিয়োগের যৌক্তিক ধাপও। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আসার আগেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এবং যেকোনোভাবেই তা চলত।

২০১৪ সাল থেকেই বিদেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মার্কিন ট্রেজারি বন্ড নিট ভিত্তিতে আর কিনছে না। অথচ আমেরিকার বাজেট ঘাটতি বাড়ছেই। ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ফেডারেল ঋণ ২৩ ট্রিলিয়ন থেকে ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়—যা যুদ্ধকাল ছাড়া নজিরবিহীন। এর মানে—ওয়াশিংটনের কাছে আর্থিক স্থিতিশীলতার কোনো বিশ্বাসযোগ্য রোডম্যাপ আর নেই। দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক সুদের হার চালিয়েই যেতে হবে—যা ডলারের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমাবে। বিশ্লেষক লুক গ্রোম্যান এটিকে “জাতির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার মতো” বলে তুলনা করেছেন।

তাই যুক্তরাষ্ট্র এখন ডলারের প্রকৃত আর্থিক দুর্বলতা স্বীকার না করে বরং ডলারের অস্ত্রায়নের কথা সামনে এনে প্রভাব সীমিত করার চেষ্টা করছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেনও বলেছিলেন—অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা ব্যবহারের ফলে ডলারের আধিপত্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে। ওয়াশিংটনের মতে, এটি কেবল ভূ-রাজনৈতিক হাতিয়ার ব্যবহারের ‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া’।

ব্রিকসও প্রকাশ্যে ডলারের অর্থনৈতিক দুর্বলতা নিয়ে তেমন কথা বলে না। কারণ তারাও বিপুল ডলার রিজার্ভ ধরে রেখেছে। এখন যদি তারা যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ–সঙ্কট নিয়ে প্রকাশ্যে সন্দেহ তোলে, তাদের নিজেদের বন্ড-সম্পদের মূল্য কমে যেতে পারে রাতারাতি।

তাই ব্রিকস দেশগুলো নীরবে স্বর্ণ কিনছে—যা এখন বিশ্বের দ্রুততম বাড়তে থাকা রিজার্ভ সম্পদ। পাশাপাশি ডলার ছাড়া দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াচ্ছে, নতুন আর্থিক অবকাঠামো বানাচ্ছে। তবে প্রকাশ্যে তারা ‘ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা’ ও ‘বৈচিত্র্যকরণ’-এর মতো নিরীহ বক্তব্য দেয়।

শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে—ওয়াশিংটন এবং ব্রিকস উভয় পক্ষই ডলার-বিমুখতার কারণ হিসেবে নিষেধাজ্ঞা ও ভূ-রাজনীতিকে সামনে আনছে, কিন্তু ডলারের দুর্বল আর্থিক ভিত্তি নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলছে না। দুই পক্ষের গল্প এক হলেও উদ্দেশ্য ভিন্ন—ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকরা হয়তো সত্যিই নিজেদের বক্তব্য বিশ্বাস করেন, আর ব্রিকস দেশগুলো পরিস্থিতি বোঝে এবং ধীরে ধীরে ব্যবস্থা বদলাতে সতর্কভাবে এগোচ্ছে।