এনবিএস ওয়েবডেস্ক প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর, ২০২৫, ০৭:১১ পিএম

১৯৯০-এর দশকের ভয়াবহ বসনিয়া যুদ্ধ নিয়ে আবারও সামনে এসেছে চাঞ্চল্যকর এক অভিযোগ। বলা হচ্ছে, সে সময় কিছু ইতালীয় নাগরিক ‘স্নাইপার সাফারি’ নামে এক নৃশংস খেলায় অংশ নিতেন—যেখানে অর্থের বিনিময়ে সারায়েভোর সাধারণ মানুষকে গুলি করার সুযোগ দেওয়া হতো। তিন দশক আগের এই অভিযোগ নতুন করে তদন্ত শুরু করেছে ইতালির মিলান প্রসিকিউটর দপ্তর।
অভিযোগটি দায়ের করেন ইতালীয় সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক এজিও গাভাজ্জেনি। তার দাবি, অস্ত্রপ্রেমী ধনী ব্যক্তিরা বিপুল অর্থ দিয়ে সার্ব বাহিনী নিয়ন্ত্রিত সারায়েভোর রাস্তায় হাঁটতে থাকা সাধারণ মানুষ—পুরুষ, নারী, এমনকি শিশুকেও—শিকার করতেন। হত্যার টার্গেট অনুযায়ী অর্থ নেওয়া হতো ভিন্ন ভিন্ন হার ধরে। বসনিয়া যুদ্ধের সময় চার বছর সারায়েভো ছিল অবরুদ্ধ, আর এতে ১১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়।
১৯৯০-এর দশকে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পরই বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সার্ব বাহিনী ঘিরে রাখে সারায়েভো, চালায় নিরন্তর গোলাবর্ষণ আর স্নাইপার হামলা।
সারায়েভোতে স্নাইপার ‘ট্যুর’ বা মানব শিকারের অভিযোগ নতুন নয়। তবে এবার গাভাজ্জেনি যে প্রমাণ জমা দিয়েছেন, তাতে রয়েছে ইতালিরই এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার সাক্ষ্য। সেই তথ্য এখন খতিয়ে দেখছেন ইতালির সন্ত্রাসবিরোধী প্রসিকিউটর আলেসান্দ্রো গোব্বিস।
বসনিয়ার সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ১৯৯৩ সালের শেষ দিকে তার সহকর্মীরা প্রথম এই ‘সাফারি’র কথা জানতে পারেন। ১৯৯৪ সালের শুরুতে বিষয়টি জানানো হয় ইতালির সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা সিসমি-কে। কিছু মাস পর সিসমি জানায়—উত্তর ইতালির ত্রিয়েস্তে শহর থেকে পর্যটকরা উড়ে এসে সারায়েভোর আশপাশের পাহাড়ে পৌঁছাতেন। পরে সিসমি আশ্বস্ত করে বলে, “আমরা বিষয়টির ইতি টেনেছি, আর কোনো সাফারি হবে না।” এরপরই নাকি এ ধরনের ‘ট্যুর’ বন্ধ হয়ে যায়।
সন্ত্রাসবাদ ও মাফিয়া নিয়ে লেখার জন্য পরিচিত সাংবাদিক এজিও গাভাজ্জেনি প্রায় ৩০ বছর আগে প্রথম এ ধরনের ‘স্নাইপার ট্যুর’-এর কথা পড়েছিলেন। তখন কোনো শক্ত প্রমাণ ছিল না। তবে ২০২২ সালের একটি ডকুমেন্টারি দেখে তার আগ্রহ আবারও জাগে। সেখানে দাবি করা হয়—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইতালি সহ আরও কয়েক দেশের ধনী পর্যটকরা সারায়েভোতে এসে মানুষ হত্যার অভিযানে অংশ নিতেন।
এরপর গাভাজ্জেনি নতুন করে অনুসন্ধান শুরু করেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ১৭ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট জমা দেন প্রসিকিউটরদের কাছে—যেখানে রয়েছে সাক্ষ্য, নথি এবং সাবেক সারায়েভো মেয়র বেনজামিনা কারিচের প্রতিবেদন।
ইতালির দৈনিক লা রিপাবলিকা-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গাভাজ্জেনি দাবি করেন—অন্তত ১০০ জন বিদেশী এ ‘খেলায়’ অংশ নিয়েছিলেন। শুধু ইতালীয় নাগরিকদের মধ্যেই কেউ কেউ জনপ্রতি প্রায় ১ লাখ ইউরো (প্রায় ৮৮ হাজার পাউন্ড) পর্যন্ত খরচ করেছেন মানুষ হত্যার সুযোগ পেতে।
১৯৯২ সালে রুশ লেখক ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক এদুয়ার্দ লিমোনভকেও সারায়েভোর দিকে ভারী মেশিনগান দিয়ে গুলি চালাতে দেখা যায়। তিনি ছিলেন কুখ্যাত সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচ-এর অতিথি—যিনি পরে জাতিসংঘ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার দায়ে দণ্ডিত হন। তবে লিমোনভ এই ‘সাফারি’তে কোনো টাকা দেননি।
ইতালীয় তদন্তকারীরা ইতিমধ্যেই সম্ভাব্য কিছু সাক্ষীর তালিকা করেছেন। তবে অভিযোগ নিয়ে রয়েছে তীব্র সন্দেহও। ১৯৯০-এর দশকে সারায়েভোতে দায়িত্ব পালন করা ব্রিটিশ সেনারা বিবিসিকে জানিয়েছেন—তারা কখনো ‘স্নাইপার পর্যটন’ সম্পর্কে কিছু শোনেননি। তাদের দাবি—সারায়েভোর চারপাশে এত চেকপয়েন্ট ও কড়া নিরাপত্তা ছিল যে বাইরে থেকে কেউ টাকায় মানুষ হত্যার ‘ট্যুরে’ আসা প্রায় অসম্ভব। এক ব্রিটিশ সেনা তো পুরো বিষয়টিকেই বলেছেন—‘আরবান মিথ’।