ঢাকা, মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৫ | ১৬ পৌষ ১৪৩২
Logo
logo

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত


মৌসুমী আক্তার     প্রকাশিত:  ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০১:১২ পিএম

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত

আজ বাংলাদেশের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে এক গভীর শোকে। একটি নক্ষত্রের পতন হলো আজ, যাঁর আলোয় দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে আলোকিত ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির পথ। কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন, আপোষহীন দেশনেত্রী, মাদার অফ ডেমোক্রেসি বেগম খালেদা জিয়া আর আমাদের মাঝে নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। যে মানুষটি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গণতন্ত্রের জন্য, দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন, তিনি আজ পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। এই সেই নেত্রী, যিনি স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছিলেন। আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবো তাঁর এই মহাজীবন।

আজ ভোরে যখন আযানের ধ্বনি ভেসে আসছিল, ঠিক তখনই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তাঁর এই চলে যাওয়া কেবল একটি দলের বা পরিবারের ক্ষতি নয়, বরং এটি সমগ্র বাংলাদেশের রাজনীতির এক অপূরণীয় ক্ষতি। দীর্ঘ রোগভোগের পর মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন তিনি। মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই কান্নায় ভেঙে পড়েন হাজারো নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। হাসপাতালের সামনে ভিড় করা মানুষের চোখের জলই বলে দিচ্ছিল, তিনি কতটা আপন ছিলেন এই দেশের মানুষের কাছে।

বেগম খালেদা জিয়া কেবল একটি নাম নয়, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এক মূর্ত প্রতীক। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করা সেই ছোট্ট পুতুল যে একদিন বাংলাদেশের কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করবেন, তা হয়তো কেউ ভাবেনি। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত অথচ দৃঢ়চেতা। দিনাজপুরে বাবার কর্মসূত্রে তাঁর শৈশব কাটে এবং সেখানেই তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন তিনি ছিলেন এক সাধারণ গৃহবধূ, রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। কিন্তু নিয়তি তাঁর জন্য লিখে রেখেছিল এক অন্যরকম ইতিহাস।

১৯৭১ সাল, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন এক বন্দী। স্বামী জিয়াউর রহমান যখন রণাঙ্গনে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন, তখন দুই শিশু সন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন বেগম জিয়া। সেই কঠিন দিনগুলোতেও তিনি অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আবার ফিরে যান তাঁর সাজানো সংসারে। স্বামী জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও তিনি ছিলেন অন্তরালে, রাজনীতি নিয়ে তাঁর কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। তিনি ছিলেন সন্তানদের মা আর স্বামীর যোগ্য সহধর্মিণী। কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক গভীর ট্রাজেডি তাঁর জীবনের মোড় সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেয়।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি যখন অস্তিত্ব সংকটে, ঠিক তখনই দলের হাল ধরেন তিনি। গৃহবধূ থেকে তিনি হয়ে ওঠেন রাজপথের লড়াকু সৈনিক। ১৯৮২ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার ক্ষমতা দখল করলে শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রাম। তিনি আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া চষে বেড়িয়েছেন। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে গিয়েছেন, তাদের কথা শুনেছেন। তাঁর ডাকে সারা দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তাঁর আপোষহীন ভূমিকার কারণে জনগণ ভালোবেসে তাঁকে উপাধি দেয় "আপোষহীন নেত্রী"।

নয় বছরের দীর্ঘ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পর ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটে। ১৯৯১ সালের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বাধীন বিএনপি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন বেগম খালেদা জিয়া। এটি ছিল কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো মুসলিম বিশ্বের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, একজন নারীও দক্ষতার সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন। তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার প্রসার, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং কৃষি বিপ্লবের মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ গৃহীত হয়। তিনি অবৈতনিক নারী শিক্ষা চালু করে গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়নে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি স্বল্প সময়ের জন্য তিনি ক্ষমতায় এলেও, পরবর্তীতে তিনি পদত্যাগ করেন এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করেন। এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেন। রাজপথে এবং সংসদে তিনি সবসময় জনগণের পক্ষে কথা বলেছেন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে চার দলীয় জোটের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি আবারও দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। তাঁর এই তৃতীয় মেয়াদে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে পৌঁছায় এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়।

কিন্তু রাজনীতির এই দীর্ঘ পথচলায় তাঁকে বারবার কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ১/১১-এর সময় মাইনাস টু ফর্মুলার ষড়যন্ত্রের শিকার হন তিনি। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং দীর্ঘদিন কারাবন্দী রাখা হয়। তাঁর দুই সন্তানকেও গ্রেপ্তার করে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। কিন্তু কোনো চাপ বা হুমকির কাছেই তিনি মাথা নত করেননি। তিনি দেশ ত্যাগ করার প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই, এই দেশই আমার সব, এই দেশের মানুষের মাঝেই আমি বাঁচতে চাই, এখানেই মরতে চাই।" তাঁর এই দেশপ্রেম তাঁকে জনগণের হৃদয়ে আরও উচ্চাসনে বসিয়েছিল।

পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে তাঁকে একের পর এক মিথ্যা মামলায় জর্জরিত করা হয়। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁকে একটি ভিত্তিহীন দুর্নীতি মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে নাজিমুদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারে একাকী রাখা হয়েছিল। সেখানে তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না, তবুও তিনি ভেঙে পড়েননি। তিনি ছিলেন মানসিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়, কিন্তু তাঁকে জামিন দেওয়া হয়নি। বছরের পর বছর তিনি কার্যত গৃহবন্দী অবস্থায় ছিলেন, যা ছিল মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

তাঁর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো যখন প্রবাসে মারা যান, তখনো তিনি ছিলেন অবরুদ্ধ। ছেলের লাশ দেখার জন্য যখন তিনি অপেক্ষা করছিলেন, তখনো তাঁর ওপর চালানো হয়েছিল মানসিক নির্যাতন। একজন মা হিসেবে সেই শোক তিনি কীভাবে সহ্য করেছিলেন, তা কেবল মহান আল্লাহই জানেন। তবুও তিনি দেশের স্বার্থে, দলের স্বার্থে নিজেকে শান্ত রেখেছিলেন। তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানকেও মিথ্যা মামলা দিয়ে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। মা ও ছেলের এই বিচ্ছেদ ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তবুও তিনি দলের নেতাকর্মীদের সবসময় ঐকবদ্ধ থাকার পরামর্শ দিতেন।

বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ক্ষমতার উৎস জনগণ। তাই তিনি আজীবন সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন। তাঁর রাজনীতি ছিল সাধারণ মানুষের জন্য। তিনি যখনই ক্ষমতায় গিয়েছেন, কৃষকের কথা ভেবেছেন, শ্রমিকের কথা ভেবেছেন। তিনি সার ও তেলের দাম কমিয়ে কৃষকদের স্বস্তি দিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে বাংলাদেশে শিল্প কারখানার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। তিনি সবসময় চাইতেন বাংলাদেশ একটি আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাবান রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক।

তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। তিনি আড়ম্বর পছন্দ করতেন না। ধর্মপ্রাণ এই নেত্রী সবসময় আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতেন। কারাগারে থাকাকালীন তিনি নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং ইবাদত বন্দেগিতে সময় কাটাতেন। তাঁর এই ধর্মপরায়ণতা এবং ধৈর্যের গুণ তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। তিনি কখনোই প্রতিহিংসার রাজনীতি করেননি। বরং তিনি সবসময় জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, হানাহানি করে নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ ও দর্শন আমাদের সাথে থাকবে। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হয়, কীভাবে হাজারো বাধার মুখেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়। তাঁর মৃত্যুতে বিএনপির নেতাকর্মীরা আজ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল। কিন্তু তাঁর এই চলে যাওয়া মানেই শেষ নয়। তাঁর আদর্শকে বুকে ধারণ করে নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব আজ আমাদের সকলের কাঁধে।

শেষ সময়ে তাঁর পাশে ছিলেন পরিবারের সদস্যরা এবং দলের শীর্ষ নেতারা। চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তাঁকে সুস্থ করে তোলার, কিন্তু বিধির বিধান খণ্ডানোর সাধ্য কারো নেই। তাঁর মৃত্যুর খবরে সারা দেশে শোকের মাতম চলছে। রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে আজ সবাই স্বীকার করছেন যে, বাংলাদেশ একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক নেতাকে হারাল। তাঁর শূন্যতা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়।

আজকের এই শোকের দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক, আমরা তাঁর দেখানো পথে চলব। আমরা গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখব এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বদা সজাগ থাকব। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, আপনি চলে গেলেন, কিন্তু আপনি বেঁচে থাকবেন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বদ্বীপের প্রতিটি ধূলিকণায়। আপনি বেঁচে থাকবেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। আপনার নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আল্লাহ আপনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন, আমিন।