সেঞ্চুরির ফুল ফুটিয়ে সুবাসিত মুশফিক


চরম নাটকীয়তা, উৎকণ্ঠা, রোমাঞ্চ, অপেক্ষা কেবল ১ রানের জন‌্য। নখ কামড়ানো এক মুহূর্ত। চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পড়ার ক্ষণ। করতালি নাকি আরেকবার আফসোস? সিলেটের ২২ গজে কোনটা অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন‌্য।

ইনিংসের শেষ বল। এগিয়ে যাচ্ছেন গ্রাহাম হিউম। ডানহাতি পেসারের লো ফুলটস বল ডিপ মিড উইকেটে পাঠিয়ে মুশফিকের ভো দৌড়। ৯৯ থেকে মুশফিকের রান পৌঁছে গেল এক’শ-তে। সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে উপস্থিত ৫ হাজার দর্শকের কণ্ঠে কেবল একটাই নাম, ‘মুশফিক...মুশফিক...মুশফিক।’

প্রান্ত বদল শেষেও দৌড় থামান না মুশফিক। ছুটে যান ড্রেসিংরুমের দিকে। ব‌্যাট-হেলমেট আকাশে তুলে গগণবিদারী চিৎকার। হাত থেকে সেগুলো ফেলে এরপর শোকরানা সিজদা করলেন।

ততক্ষণে সতীর্থ তাসকিন এসে তাকে আলিঙ্গনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। মুখে চওড়া হাসি নিয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন। এ যেন অনন্তের অপেক্ষার সমাপ্তি! সাকিব, হৃদয় প্রথম ওয়ানডেতে যা পারেননি, দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বড় সুযোগ পেয়েও লিটন, শান্ত হাতছাড়া করছেন। মুশফিক সেই মঞ্চেই সেঞ্চুরির ফুল ফোটালেন। সুবাসিত করেছেন বাংলাদেশের ইনিংস।

একদিন আগেই বাংলাদেশ নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৩৩৮ রান করেছিল। ৪৮ ঘণ্টার ব‌্যবধানে সেই রেকর্ড টিকে থাকেনি। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ৬ উইকেটে ৩৪৯। ষোলো ইনিংস পর মুশফিক পেলেন নিজের সেঞ্চুরি। তবে ওয়ানডে ক‌্যারিয়ারের নবম সেঞ্চুরিটা মুশফিক বিশেষভাবে রাঙিয়েছেন। বাংলাদেশের হয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড এখন তার দখলেই। ২০০৯ সালে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঝড় তুলে সাকিব ৬৩ বলে সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন। ১৪ বছরের রেকর্ড ভেঙে মুশফিক সাকিবকে টপকালেন। সঙ্গে ওয়ানডেতে ৭০০০ রান পেরিয়ে উদ্ভাসিত এ ব‌্যাটসম‌্যান।

৬ বছর পর প্রথম ওয়ানডেতে ছয় নম্বর পজিশনে নেমেছিলেন মুশফিক। দীর্ঘদিন পর পজিশন বদলালেও তার ব‌্যাটিংয়ের ধার একটুও কমেনি। বরং দলের প্রয়োজনমাফিক আক্রমণাত্মক ব‌্যাটিং করে ২৬ বলে ৪৪ রান করেন।

আজ মুশফিকের ব‌্যাট আরও ধারালো। ৩৪তম ওভারে নাজমুল হোসেন শান্ত যখন আউট হন তখন ক্রিজে আসেন মুশফিক। একে তো ছয় নম্বর পজিশন, সঙ্গে হাতে কম বল। অপরপ্রান্তে থাকা তৌহিদ হৃদয়ের রান ক্ষুদা তার চেয়েও বেশি। সেখান থেকে মুশফিকের সেঞ্চুরির চিন্তা করা অনেকটাই আকাশকুসুম কল্পনা। কিন্তু নিজের ২৪৪ ইনিংস খেলতে নামা মুশফিক আজ ছিলেন ভিন্ন রূপে, অন‌্যরকম আবহে। দারুণ সব কভার ড্রাইভ, ইনসাইড আউট, পুল সুইপে মনে হচ্ছিল ম‌্যাচে নয় নেটে ব‌্যাটিং করছিলেন। যেভাবে চাচ্ছিলেন সেভাবেই বল উড়াতে পারছিলেন।

৩৩ বলে পঞ্চাশ ছুঁয়ে ফেলেন ৫ চার ও ২ ছক্কায়। এরপর তাকে আর থামানোই যায়নি। উইকেটের চারিপাশে দৃষিনন্দন সব শট, অ‌্যাকুরেসি, টাইমিং, প্লেসমেন্ট মিলিয়ে অনন‌্য, অসাধারণ এক ইনিংস উপহার দেন। সঙ্গী হৃদয়ের সঙ্গে তার জুটি ছিল ৭৮ বলে ১২৮ রানের। যেখানে মুশফিকের অবদান ৪৬ বলে ৭৮, হৃদয়ের ৩২ বলে ৪৮।

হৃদয় ফিফটি থেকে ১ রান দূরে থাকতে আউট হলেও মুশফিক সেঞ্চুরির পূর্ণ করবেন এমন পণ করেই রেখেছিলেন। কিন্তু শেষ ওভারে দেখা যায় চরম নাটকীয়তা। ৯১ রানে তখন অপরাজিত মুশফিক। হিউমের প্রথম বল উড়াতে গিয়ে ইয়াসির আলী রাব্বী আউট হন। নতুন নিয়মে নতুন ব‌্যাটসম‌্যানকেই থাকতে হবে স্ট্রাইকিং প্রান্তে। তাতে তাসকিন আহমেদ চলে আসেন দ্বিতীয় বল খেলতে। তাসকিন সিঙ্গেল নিলে তৃতীয় বলে স্ট্রাইক পান মুশফিক। হাতে ৪ বল রেখে মুশফিকের সেঞ্চুরির জন‌্য প্রয়োজন ৯ রান। তৃতীয় বল স্কয়ার লেগে পাঠিয়ে ২ রান নেন মুশফিক। পরের বল রিভার্স স্কুপ করে চার মেরে ৯৭ রানে পৌঁছান।

এর আগে নব্বইয়ে গিয়ে চারবার সেঞ্চুরি না পাওয়ার রেকর্ড আছে মুশফিকের। এবারও কি তেমন কিছু হবে? শঙ্কা, উৎকণ্ঠা চারিদিকে। পঞ্চম বল আবার ফ্লিক করে ২ রান মুশফিকের। ইনিংসের শেষ বলে ডানহাতি ব‌্যাটসম‌্যানের প্রয়োজন ১ রান। পারবেন তো মুশফিক? সমীকরণ মিলিয়ে নিলেন। অপেক্ষা দূর করলেন। পাঁচ ম‌্যাচ পর বাংলাদেশের কোনো ব‌্যাটসম‌্যান রঙিন পোশাকে পেলেন সেঞ্চুরি। সবশেষ ভারতের বিপক্ষে মেহেদী হাসান মিরাজও ইনিংসের শেষ বলে তিন অঙ্ক ছুঁয়েছিলেন। এবার মুশফিক। রুদ্ধশ্বাস এমন মুহূর্তে মাইলফলক ছোঁয়ার আনন্দটা তাই প্রবলভাবেই তাদের চোখেমুখে ধরা পড়ে। ১৪ চার ও ২ ছক্কায় সাজানো ইনিংসটি নিশ্চিতভাবেই অর্জনের তালিকায় উপরে রাখবেন।

কারণ, দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড পাওয়ার দিনে মুশফিক ওয়ানডেতে ৭ হাজার রানের মাইলফলকও পেরিয়ে গেছেন। ৫৫ রান দূরে থাকতে মাঠে নেমেছিলেন। ২৪৪ ইনিংসে তার রান এখন ৭০৪৫। তামিম ও সাকিবের পর তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে অনন‌্য এ রেকর্ডবুকে নিজের নাম তোলেন সেঞ্চুরির ফুল ফোটানো মুশফিক। যার সুবাস বইছে সিলেট জুড়ে।

news