কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলে ইরানের দ্বিতীয় পর্বে ওঠার সম্ভাবনা কতটুকু

কাতার বিশ্বকাপে থাকা 'গ্রুপ-বি'তে আছে ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ওয়েলস এবং ইরান।‌‌ ফিফা র‍্যাংকিংয়ে দলগুলোর অবস্থান যথাক্রমে ৫, ১৬, ১৯ এবং ২০। এই গ্রুপ থেকে ইংল্যান্ডের পরের রাউন্ডে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত তবে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে যুক্তরাষ্ট্র, ওয়েলস এবং ইরানের‌ শক্তিমত্তার বিচারে এই তিন দলই বেশ কাছাকাছি।

১৯৭৮ সাল থেকে এই বিশ্বকাপ পর্যন্ত বিশ্বকাপে ইরান ষষ্ঠবারের মতো অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে। এর মধ্যে শেষ তিন বিশ্বকাপেই তারা টানা অংশগ্রহণ করেছে। এশিয়া কাপ ফুটবলে জাপানের (চারবার শিরোপা জিতেছে জাপান) পর সর্বোচ্চ তিনবার করে শিরোপা জিতেছে ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়া। তবে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব কখনোই পার করতে পারেনি ইরান। ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ২-১ গোলে জয় এবং সর্বশেষ ২০১৮ বিশ্বকাপে মরক্কোকে ১-০ গোলে হারানো, এই দুটি জয়ই তাদের সেরা সাফল্য। ইরান প্রতিটি বিশ্বকাপে ন্যূনতম ১ পয়েন্ট হলেও পেয়েছে, তবে ২০১৮ সালে তারা সর্বোচ্চ ৪ পয়েন্ট অর্জন করেছিল এবং সে যাত্রায় শক্তিশালী পর্তুগালের সঙ্গেও ১-১ গোলে ড্র করেছিল।

ইরানের জাতীয় দলের কোচ কার্লোস কুইরোজ

তিন বছর বিরতি দিয়ে কোচ কার্লোস কুইরোজ‌ আবারও ইরানের জাতীয় দলের দায়িত্বে ফিরেছেন। তার নেতৃত্বে ইরান ২০১৪ এবং ২০১৮ বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছিল। প্রথম দফায় তিনি কোচ ছিলেন ৮ বছর। ক্লাব ক্যারিয়ারে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হওয়ার আগে আরব আমিরাত এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে তিনি কোচিং করিয়েছেন। পরবর্তীতে পর্তুগাল, ইরান, কলম্বিয়া এবং মিশরেরও কোচ ছিলেন কুইরোজ। তিনি ইরানে অনেক জনপ্রিয় কোচ কারণ তার নেতৃত্বে ২০১৪ সালে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে মাত্র ১-০ গোলে এবং ২০১৮ সালে স্পেনের কাছে একই ব্যবধানে হারের পরেও ইরানিরা রাস্তায় নেমে তার জন্য গলা ফাটিয়েছিল।


কার্লোস কুইরোজ‌
ইরানের বিশ্বকাপ সময়সূচি:

ইরান ২১শে নভেম্বর [বাংলাদেশ সময়] সন্ধ্যা ৭টায় প্রথম ম্যাচ খেলবে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৪৫ হাজার ৪১৬ জন দর্শক আসন বিশিষ্ট ‘খলিফা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে’। দ্বিতীয় ম্যাচ খেলবে ওয়েলসের বিরুদ্ধে ২৫শে নভেম্বর [বাংলাদেশ সময়] বিকাল ৪টায় আর ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে ‘আল রাইয়ান স্টেডিয়ামে’, যার দর্শক ধারন ক্ষমতা ৪৪ হাজার ৭৪০। ‘আল থুমানা’র ৪০ হাজার আসন বিশিষ্ট স্টেডিয়ামে খেলবে গ্রুপের শেষ ম্যাচ চিরশত্রু  যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, যেটি অনুষ্ঠিত হবে ৩০শে নভেম্বর [বাংলাদেশ সময়] রাত ১টায়।

বিশ্বকাপে ইরান কতদূর যেতে পারে:

বিশ্বকাপ ইতিহাস অনুযায়ী ইরানকে প্রায়ই একটি ম্যাচে ভালো খেলতে দেখা যায়। আর সেই একটি জয় যদি যুক্তরাষ্ট্র বা ওয়েলসের বিরুদ্ধে তুলে নিতে পারে এবং সেই সঙ্গে একটি ড্র থাকে তবে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়াটা তাদের জন্য বেশ সহজ হয়ে যাবে। সম্প্রতি উরুগুয়ের বিরুদ্ধে প্রীতি ম্যাচে ১-০ গোলের জয় নিশ্চয়ই তাদের মনোবল বাড়িয়ে দেবে। যুক্তরাষ্ট্র সেপ্টেম্বর মাসে এশিয়ার দুইটি দেশের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেলে একটিতে জাপানের কাছে ০-২ গোলে হেরেছে আর অন্যটিতে সৌদি আরবের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করেছে। তাই ইরান যদি আবারও ১৯৯৮ সালের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জয় পায় আর সেই সঙ্গে ওয়েলসকে রুখে দিতে পারে তাহলেই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে ইরান।

খেলার ফর্মেশন:

ইরান এবারের বিশ্বকাপে ৪-১-৪-১ পদ্ধতিতে খেলতে পারে। তাদের খেলার মূল পরিকল্পনাই থাকবে ডিফেন্সকে শক্তপোক্ত রাখা যাতে গোল হজম করতে না হয়। প্রীতি ম্যাচে সেনেগালের সঙ্গে ড্র করা শেষ ম্যাচটিতে ইরানি দল প্রতি আক্রমণের সঙ্গে নিচ থেকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিয়েছে। প্রধান স্ট্রাইকার হিসেবে সারদার আজমুন খেলবেন কিনা তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। কেননা ইনজুরি থেকে এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। তিনি যদি ফিট না হতে পারেন তাহলে সে জায়গায় মেহদি তারেমি খেলবেন। আর যদি আজমুন ফিট থাকেন তাহলে তারেমি‌ লেফট উইঙ্গার হিসেবে খেলতে পারেন।

শক্তিমত্তা ও দুর্বলতা:

এশিয়ান দেশ হিসেবে ইরান নিশ্চয়ই কাতারে এক ধরনের বাড়তি উদ্দীপনা নিয়ে খেলবে। তাদের দলে প্রায় ১৫ জন খেলোয়াড় আছে যাদের পূর্ববর্তী বিশ্বকাপে‌ খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। গ্রীক লিগে খেলা অধিনায়ক এহসান হাজসাফি এবং মিলাদ মোহাম্মদী দলের রক্ষণ সামলাবেন।‌‌ হাজসাফি এখন পর্যন্ত ১২১টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। আক্রমণভাগে আলী রেজা জাহানবাখশ, মেহদি তারিমি এবং সারদার আজমুন দীর্ঘদিন যাবৎ ইউরোপে খেলছেন। তারা ইতোমধ্যে ৬০৮টি ম্যাচ খেলেছেন রাশিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড এবং পর্তুগালের শীর্ষ লিগে।‌‌ অর্থাৎ দলটিতে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যে খেলার অভিজ্ঞতার মিশ্রণ রয়েছে।

যাদের দিকে চোখ রাখতে হবে:

সারদার আজমুন: ফরোয়ার্ড, সরদার আজমুন ইরানের মেসি নামে পরিচিত। ২৭ বছরের এই স্ট্রাইকার বর্তমানে খেলছেন জার্মানির বায়ার লেভারকুজেনে।‌‌ তিনি যথেষ্ট সৃজনশীল এবং হঠাৎ করে গতি বাড়ানোর জন্য পরিচিত। হেড করতে তিনি যথেষ্ট ভালো বিধায় তাকে ইব্রাহিমোভিচের সাথেও তুলনা করা হয়। আলী দায়ির পরে তিনিই ইরানের সবচেয়ে সফলতম ফুটবলার। আলী দায়ি প্রতিটি গোল করতে ১.৩৬টি ম্যাচ খেলেছেন, যেখানে আজমুনকে খেলতে হয়েছে ১.৫৮টি ম্যাচ। তার বর্তমান মার্কেট ভ্যালু হচ্ছে ২৮.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।


সারদার আজমুন
মেহদি তারেমি: ‘আমি আফসোস করছি যে এই ছেলেটি ইউরোপিয়ান ফুটবলে বেশি আগে যায়নি এবং এটা আমার দোষ‌ ছিল।’ কয়েক মাস আগে কাঁদতে কাঁদতে ফুটবল বিষয়ক টিভি শোতে এই কথাটি বলছিলেন মেহদি তারেমির বাবা। ৩০ বছরের এই স্ট্রাইকার, ২০১৮ বিশ্বকাপের পর পর্তুগিজ লিগে খেলতে যাওয়ার পর থেকে ললিগ এবং জাতীয় দলের হয়ে প্রতি দুই ম্যাচ অন্তর গোল করে যাচ্ছেন। আলীরেজা জাহানবখশ এবং সরদার আজমুনের সাথে তার গোল করার দক্ষতার উপর নির্ভর করবে ইরান দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবে কিনা!

আলীরেজা জাহানবাখশ: ডাচ লিগের ফেইনুর্ড ক্লাবে খেলা ২৯ বছরের আলীরেজা জাহানবখশ ইরানের সেরা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। তিনি একজন টেকনিক্যালি গিফটেড প্লেয়ার, যার প্রমাণ ইংলিশ লিগে ব্রাইটনের হয়ে চেলসির বিরুদ্ধে একটি অত্যাশ্চর্যজনক ওভারহেড কিক দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন। ডাচ লিগের দ্বিতীয় সেরা তরুণ খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০১৪ সালে এবং ২০১৭-১৮ মৌসুমে সেখানে তিনি ২১টি গোল করে এশিয়ার প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ইউরোপের শীর্ষ লীগের সেরা গোলদাতা হন। তিনি‌ এবং অধিনায়ক হাজসাফী তৃতীয়বারের মতো ইরানের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন।

এহসান হাজসাফী: ইরানের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ফুটবলার অধিনায়ক এহসান হাজসাফী। ৩২ বছর বয়সী এই খেলোয়াড় অবিশ্বাস্য প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে লেফটব্যাক এবং ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতে পারেন। তার নেতৃত্বের গুণাবলির জন্য ক্লাব এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত। জার্মান এবং‌ গ্রীক লিগে খেলার অভিজ্ঞতাও রয়েছে এহসানের।

বিশ্বকাপে ইরানের সম্ভাব্য মূল একাদশ:

গোলরক্ষক: আলিরেজা বেইরানভান্দ (পার্সপোলিস);

ডিফেন্ডার: সাদেক মোহাররমি (লোকোমোটিভা জাগ্রেব), হোসেন কানয়ানি জাদেগান (আল-আহলি), মাজিদ হোসেইনি (কায়সারিসপোর), মিলাদ মোহাম্মদী (এইকে এথেন্স);

মিডফিল্ডার: এহসান হাজসাফি (এইকে এথেন্স), সামান কুদ্দুস (ব্রেন্টফোর্ড), আলী কুলিজাদেহ (শার্লেরোই), আলীরেজা জাহানবাখশ (ফেইনুর্ড)

ফরোয়ার্ড: মেহেদি তারেমি (এফ.সি পোর্তো) এবং সারদার আজমুন (বেয়ার লেভারকুসেন)।
খবর পার্সটুডে /এনবিএস/২০২২/একে

news