‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ এলবামের জন্য কোনো টাকা পাইনি, তবে ঈদ বোনাস হিসেবে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছি : আসিফ আকবর

আসিফ আকবর- জনপ্রিয় পপ-ধারার একজন সংগীতশিল্পী। ২০০১ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম অডিও এলবাম, ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’। এই অডিও এলবামের মাধ্যমে দেশব্যাপী ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেন। চলচ্চিত্রে তাঁর গাওয়া প্রথম গান, ‘আমারই ভাগ্যে তোমারই নাম’, ‘রাজা নাম্বার ওয়ান’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৯৮ সাল । ২০১৯ সালে ‘গহীনের গান’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আসিফ অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বাংলা গানের যুবরাজখ্যাত এই সংগীতশিল্পী কুমিল্লা জেলায় ১৯৭২ সালের ২৫ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আলী আকবর। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। তাঁর স্ত্রী সালমা আসিফ মিতু। এই দম্পতির দুই সন্তানÑ রণ ও রুদ্র। 

আসিফ আকবর এক বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন আমাদের নতুন সময় ও আমাদেরসময় ডটকমকে। তিনি কথা বলেছেন উপমহাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী, সুরকার ও গীতিকবি কবীর সুমনকে নিয়ে। কথা বলেছেন নিজের সংগীত জীবনের শুরুর গল্প। জনপ্রিয়তা লাভ। এগিয়ে যাওয়ার পথে নানান চ্যালেঞ্জ সম্পর্কেও। দেশের সংগীতাঙ্গনের হালচালও ছিলো আলাপচারিতায়। কথা বলেছেন রাজনীতি নিয়েও। ‘আকবর ফিফটি নট আউট’তে কী থাকছে, দিলেন সে ধারণাও। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ প্রকাশিত হলো আজ। 

আমাদের নতুন সময়: আপনি কেমন আছেন? শারীরিকভাবে ভালো আছেন তো?
আসিফ আকবর: শারীরিকভাবে আমি ভালো আছি। গান গাওয়া আমার প্রধান কাজ। কিন্তু গানের চেয়ে আমাকে আলগা বা অন্য কাজ করতে হয় বেশি। যেমন বিচার-আচার। এর এই সমস্যা, ওর ওই সমস্যা। নানারকম সমস্যা নিয়ে লোকজন আমার কাছে আসে, যা উচিত নয়। তবুও চলে আসে। ওসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়, নিজের কাজের চেয়েও বেশি! 

 আসিফ আকবর এখন নটআউট ফিফটি। আর কতো বছর আয়ু চান!
আসিফ আকবর: আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি, বাসার ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। এতে আমার মাথার খুলি ও হাত ফেটে গিয়েছিলো। আমার ঘাড় ডানদিক হয়ে গেছে। বেঁচে যাওয়াটাই তখন ছিলো পরম সৌভাগ্য বা জাস্ট লাক। ওই দুর্ঘটনার পর থেকে বাবা-মা আমাকে তাঁদের ‘বোনাস সন্তান’ হিসেবে ডাকতেন! বাবা-মায়ের ওই বোনাস সন্তান এখনো বেঁচে আছে। যে কাজ আমি করছি, যতোটুকু পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি, মনে হয় আমার বেঁচে থাকা সাফিসিয়েন্ট হয়ে গেছে! এখন থেকে যা হায়াৎ বা আয়ু পাবো, সবটাই বোনাস! 

কতো সাল থেকে আপনি একজন স্বীকৃত সংগীতশিল্পী হিসেবে গান করছেন। দীর্ঘ এই জার্নিটা কেমন ছিলো?
আসিফ আকবর: ২০০১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ এলবামই আমাকে একজন স্বীকৃত শিল্পী হিসেবে স্রোতাদের সামনে নিয়ে এসেছে। এরপর থেকে সিনেমার প্লেব্যাক, অডিও এলবামই আমার বেসিক। অডিও ইন্ডাস্ট্রিটা স্লিপি। কারও কোনো সহযোগিতা থাকে না। সংগীতে শিল্পীর সংখ্যা খুব কম। গীতিকার ও সুরকারের সংখ্যাও কম। এখানে রেষারেষিটাই বেশি থাকে। এই রেষারেষি আমাকেও ফেস করে আসতে হয়েছে। অনেক সিনিয়রের কঠিন চ্যালেঞ্জ বা হুমকি-ধামকিও পেয়েছি। ছোটবেলা থেকেই আমি দাঙ্গাবাজ। যদিও মারপিট বা হুমকিধামকি আমার পছন্দ নয়। যারা হুমকিধামকি দেন, তাদের আমি মানুষই মনে করি না। যোগ্য মনে করি না। পুরুষ মনে করি না। এসব হুমকিধামকি ওভারকাম করে ফেলেছি। ভালোভাবে হ্যান্ডেল করেছি। ‘আকবর ফিফটি নট আউট’-তে এসব বিষয়ে বিস্তারিত থাকবে। আমার চলার পথ কতোটা মসৃণ বা অমসৃণ ছিলো এখান থেকে জানা যাবে। সব জায়গাতেই ফাইট থাকে। ফাইট ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না। আমি কখনো প্রবলেম এড়িয়ে চলি না, মোকাবেলা করি। ফেস করার পর যেটা সিদ্ধান্ত হয়Ñ সেটা ভালো হতে পারে, খারাপও হতে পারে। কিন্তু তাতে আমি সন্তুষ্ট থাকি। 

সংগীতাঙ্গনে আপনার ফাইটটা মূলত কী, কার বা কাদের সঙ্গে?
আসিফ আকবর: একসময় সিনিয়র শিল্পী ও সুরকাররা আমার সঙ্গে কাজ করতে চাইতেন না। ফিল্মের প্লেব্যাকে একধরনের লবিং কাজ করে, যা কখনোই পছন্দ নয় আমার। আমি আমার যোগ্যতা দিয়ে যেখানে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, সেখানেই কাজ করেছি। কারও পেছনে ঘুরেটুরে কাজ করিনি। এখনো করি না। যেমন একজন প্রযোজক বা উদ্যোক্ততা একটা গান তৈরি করলেন, কিন্তু তার কোনো প্রোডাকশন হাউজ নেই। তিনি কী করলেন? বিভিন্ন  প্রোডাকশন হাউজে গান নিয়ে ঘুরাঘুরি করেন। এই সুযোগটি আমি কখনো দিইনি। আমি ওই রকম শিল্পী নই যে আমার প্রোডাক্ট নিয়ে প্রোডাকশন হাউজের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে। সেটা আমাকে করতে হয়নি। সংগীত জীবনে আমার জার্নি ইজ গুড। 

 সিনিয়র শিল্পী ও সুরকারদের এই অসহযোগিতা কি ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ রিলিজ হওয়ার আগের ঘটনা, নাকি পরের? 
আসিফ আকবর: ও প্রিয়া রিলিজ হওয়ার আগে সিনিয়রা অসহযোগিতা করেছিলেন, রিলিজ হওয়ার পরও নানান ভাবে আমাকে অসহযোগিতা করেছেন। সিনিয়ররা মনে করেছিলেন, ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ এলবাম একটা ‘ফ্লুক’। আজ এসেছে, কাল চলে যাবেÑ ধরনের মনোভাব ছিলো তাদের মধ্যে। কিন্তু তাঁরা তো আমাকে চিনতেন না, জানতেও না কেমন প্রকৃতির মানুষ আমি। চলে যাওয়ার জন্য তো আমি অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে আসিনি। অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে আমার থাকা-না থাকা নিয়ে তাঁরা হয়তো সমস্যায় পড়েছিলেন, কিন্তু আমার অবস্থানে আমি ঠিক ছিলাম। আত্মবিশ^াসী ছিলাম। স্থির ছিলাম। ফলে কেউ টলাতে পারেননি নানান ভাবে অসহযোগিতা করেও। মূলত এই সমস্যাটা তৈরি হয়েছিলো, ও প্রিয়া তুমি কোথায় এলবাম রিলিজ হওয়ার পর! সিনিয়ররা আমার সঙ্গে মিক্সড এলবামে গাইতে চাইতেন না, ডুয়েট এলবামেও গাইতে চাইতেন না। তখন আতিক বাবু ও পিয়াল হাসানদের মতো তরুণ তারকাদের সঙ্গে কাজ শুরু করে দিই। এতে অটোমেটিক সিনিয়ররা বাদ হয়ে গেছেন! তাদের নিয়ে আমি দুঃশ্চিন্তা করি না, কখনো ভাবিওনি। যখন সুযোগ পেয়েছি বড়দের সঙ্গে গেয়েছি। ওটা কোম্পানির ব্যাপার। আমি নিজ থেকে কখনো সিনিয়রদের সঙ্গে কাজ করিনি। তরুণ শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছি। এখনো তরুণদের সঙ্গেই কাজ করে যাচ্ছি। 

 সিনিয়রদের আগের সেই অবস্থান কি পরিবর্তন হয়েছে?
আসিফ আকবর: বাংলাদেশের মানুষ ‘শক্তের ভক্ত, নরমের জম’। আমার মধ্যে কঠিন দৃঢ়তা আছে। ইস্পাতসম ব্যক্তিত্ব আমার। আমি ভাঙি, কিন্তু কখনো মচকাই না। আমি চ্যালেঞ্জ নিই। সে যতো বড় চ্যালেঞ্জই হোক না কেন। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যাই। যে সমস্ত সিনিয়র আমাকে অসহযোগিতা করেছিলেন তারাই পরে আমার অনুগত হয়ে গেছেন। ভালোবাসতে বাধ্য হয়েছেন। ভালোবাসা আবার দুই প্রকারের। একটা ভয়ে ভালোবাসা, আরেকটি হচ্ছে নিজ থেকে। যিনি নিজ থেকে ভালোবাসেননি, তিনি আমাকে ভয় করে ভালোবেসেছেন। 

 আপনার ব্যস্ততা এখন কী নিয়ে? 
আসিফ আকবর: এখন তো সিঙ্গেলসের যুগ। বিভিন্ন গীতিকার, সুরকার ও কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছি। এছাড়া শ্যুটিং করি। যদিও এখন আর আউটডোর শ্যুটিং খুব একটা করি না। স্টুডিও ভার্সন করি। ট্রেন্ড বদলে ফেলছি। কারণ আমি কখনো নিজেকে বদলাই না, আমার আশপাশকে বদলে দিই। যখন মিউজিক ভিডিও এসেছিলো, তখন সেটা করেছি। পরে দেখলাম, মিউজিক ভিডিও অপ্রয়োজনীয় জিনিস, গানের সঙ্গে ওইরকম কোনো কানেকশন নেই। কেউ যদি শখ করে দুয়েকটি গান করলো, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু একটা পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে সলিড কিছু না। এখন সারাবিশে^ই এই ট্রেন্ড চলছে। বিশ্বের  বড় বড় সুপারস্টারদের ব্যস্ততাও এখন স্টুডিও কেন্দ্রিক। এটা থেকে বিশ্ব বেরিয়ে আসছে। বাংলাদেশও বেরিয়ে এসেছে। আরও বের হয়ে আসবে। ইতোমধ্যেই ৯০ শতাংশ মিউজিক ভিডিওর উৎপাত কমে গেছে। ভালো গান করলে মানুষ শুনবে। আগে অডিও ছিলো, এখন সে সুযাগও নেই। তবে অ্যাপে সেই সুযোগটি চলে আসছে। সেদিন খুব বেশি দূরে নেই যেদিন মানুষÑঅ্যাপেই অনেক গান শুনবে। 

আউটডোর শ্যুটিং কি মিস করেন? মানুষ তো আউটডোর শ্যুট পছন্দ করে বেশি। তাহলে স্টুডিওনির্ভর হয়ে পড়লেন কেন?
আসিফ আকবর : মানুষ তো অনেক কিছুই পছন্দ করে না। মানুষের পছন্দের কোনো শেষ নেই। যেখানে ফ্রি সেখানে পছন্দ খুব মারাত্মক! একটা মিউজিক ভিডিও তৈরি করতে ৫ লাখ টাকা খরচ হয়। একটা গান বানাতে প্রয়োজন পড়ে ২ লাখ টাকা। ৭ লাখ টাকা আসবে কোথা থেকে? কে দেবে? প্রোডাকশনকে দিতে হয়। প্রোডাকশনের পক্ষে এই টাকা তোলা সম্ভব নয়। মানুষ কি জানতো, ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ এমন অবিশ্বাস্য হিট এলবাম হবে? জানতো না। মানুষকে আপনি পরিচালিত করবেন। চালাবেন। যদি আপনি নেতা হন, তাহলে মানুষ আপনার কথা শুনবে। নেতা না হলে আপনি মানুষের কথামতো চলবেন। এটাই স্বাভাবিক। লিডারশিপ নিয়ে কাজ করি, আমি আমার অবস্থান বুঝি। যারা গান শোনার শুনবেন, না শুনলে নেই। আমি আমার কাজটি করে যাচ্ছি। কাউকে জিজ্ঞেস করে, কারও অনুমতি বা পরামর্শ নিয়ে ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ সৃষ্টি হয়নি। ফলে আমার উপলব্ধি হচ্ছে, নিজের যে কাজ তা ভালোভাবে করতে হবে। ভালো কাজটাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। 

news