ভারতের নারী ক্রিকেটের নতুন সেনসেশন শেফালি ভার্মা। যিনি একসময় ক্রিকেট শেখার জন্য ছেলে সেজেছিলেন, তিনিই আজ বিশ্বকাপের নায়িকা। সম্প্রতি সেমিফাইনাল আর ফাইনালে তার দুর্দান্ত ইনিংস যেন এক সিনেমার গল্পকেও হার মানিয়েছে।
বাদ পড়া থেকে হিরো হয়ে ফেরা
বিশ্বকাপ স্কোয়াড ঘোষণার সময় খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন শেফালি, তবে কারণটা সুখকর ছিল না। দলে জায়গা পাননি তিনি। নির্বাচক নিতু ডেভিড তখন জানিয়েছিলেন, “আমাদের চোখ শেফালির ওপর আছে।”
সেই “চোখ থাকা” কথার বাস্তব প্রমাণ মিলল বিশ্বকাপে। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচে প্রিতিকা রাওয়াল চোটে পড়লে সুযোগ পান শেফালি। দলে ফিরেই বলেছিলেন,
“প্রিতিকার চোটটা খুব খারাপ খবর, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ঈশ্বরই আমাকে এখানে ভালো কিছু করার জন্য পাঠিয়েছেন।”
এরপর সেমিফাইনালে ফিফটি আর ফাইনালে ৭৮ বলে ৮৭ রানের বিস্ফোরক ইনিংস, সঙ্গে ম্যাচ সেরা পারফরম্যান্স—সব মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন ভারতের নতুন নায়িকা।
কঠিন সময়, বাবার অনুপ্রেরণায় ফেরার গল্প
বিশ্বকাপের কয়েক মাস আগেই শেফালির জীবন ছিল একদম উল্টো পথে। ব্যাট হাতে ব্যর্থতার কারণে অস্ট্রেলিয়া সফরের দল থেকে বাদ পড়েন। এরই মধ্যে তার বাবা সঞ্জীব ভার্মার হার্ট অ্যাটাক হয়।
শেফালি বলেন,
“বাবাকে বাদ পড়ার খবর জানাতে পারিনি। কারণ, দল ঘোষণার দুই দিন আগেই তিনি হাসপাতালে ছিলেন।”
বাবাই তার ক্রিকেট জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি মেয়েকে নতুন করে লড়াইয়ের সাহস দেন। বাবার পরামর্শে শেফালি আবার ফিরে যান ক্রিকেটের বেসিকে, নতুন করে অনুশীলন শুরু করেন।
ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরে ৯০০ রানেরও বেশি সংগ্রহ করেন, যার মধ্যে একাধিক সেঞ্চুরিও ছিল। আর এই পারফরম্যান্সই তাকে ফিরিয়ে দেয় জাতীয় দলে।
হরিয়ানার এক মেয়ে, যে ছেলে সেজেছিল ক্রিকেট শেখার জন্য
হরিয়ানার রোতাক জেলার মেয়ে শেফালির জন্ম এমন এক সমাজে, যেখানে মেয়েদের খেলাধুলা করা প্রায় নিষিদ্ধ। তার বাবা সঞ্জীব ভার্মা, পেশায় একজন জুয়েলারি ব্যবসায়ী, কিন্তু মনে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ছিল।
মেয়ের প্রতি ভালোবাসা আর ক্রিকেট-পাগল মন মিলিয়ে তিনি জেদ ধরলেন—যেভাবেই হোক, মেয়েকে ক্রিকেটার বানাবেন।
কিন্তু সমস্যাটা ছিল বড়—কোনো একাডেমি মেয়েদের ভর্তি নেয় না। তখন এক অসাধারণ সিদ্ধান্ত নেন সঞ্জীব। শেফালির চুল ছোট করে কেটে দেন, ভাইয়ের মতো সাজিয়ে তাকে ছেলের ছদ্মবেশে ভর্তি করান শ্রী রাম নারায়ণ ক্রিকেট একাডেমিতে।
সেখানেই শুরু হয় ছেলেসেজে শেফালির ক্রিকেটযাত্রা। তবে বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যায়নি। বিষয়টি প্রকাশ পেতেই প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন সঞ্জীব।
চাপে না ভেঙে, লড়াই করে জয়
একদিকে সমাজের কটূক্তি, অন্যদিকে ব্যবসায় মন্দা—সব মিলিয়ে কঠিন সময় আসে ভার্মা পরিবারের জীবনে। কিন্তু শেফালি থামেননি। প্রতিদিন নিয়ম করে অনুশীলনে গেছেন।
একবার ভাই সাহিল ভার্মা অসুস্থ হলে, শেফালি আবার ছেলের ছদ্মবেশে খেলেন অনূর্ধ্ব-১২ টুর্নামেন্টে, এবং সেখানেই হন ম্যান অব দ্য সিরিজ!
এরপর ১৫ বছর বয়সে ইতিহাস গড়েন—ভারতের সবচেয়ে কমবয়সী নারী টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে। এরপর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জেতা, অসংখ্য রেকর্ড গড়া—সবই যেন তার অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রমাণ।
বিশ্বকাপে নতুন অধ্যায়
ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৮ বলে ৮৭ রান করে ব্যাটে জ্বলে ওঠেন শেফালি। এরপর বল হাতে ৩৬ রানে ২ উইকেট নিয়ে ম্যাচের সেরা হন।
“ছেলে সাজা” থেকে “বিশ্বকাপের নায়িকা”—শেফালি ভার্মার এই যাত্রা শুধু ক্রিকেট নয়, এটি এক অসাধারণ জীবনের অনুপ্রেরণার গল্প।
                                
                                
	
                                
                    
                                                                                    