১০ বার এভারেস্ট সামিট! বাসন মেজে দিন কাটানো একলা মায়ের অনন্য রেকর্ড

 এই নিয়ে দশম বার (10th time)। বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট (Everest) আরোহণ করে, নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙলেন তিনি। তিনি নেপাল থেকে এভারেস্ট ছোঁয়া প্রথম মহিলা, লাকপা শেরপা (Lakpa Sherpa)! তবে এই দশবার এভারেস্ট আরোহণের রেকর্ডও আর পাঁচটা রেকর্ডের চেয়ে আলাদা। কারণ এই এভারেস্ট শৃঙ্গ অভিযানের জন্য তাঁকে যে কত হাজার বাধার এভারেস্ট পেরোতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।

প্রতিদিন ছ’টা বাজলেই খুলে যায় চোখের পাতা। যন্ত্রের মতো অভ্যেস হয়ে গেছে। দুই মেয়েকে তৈরি করেন তাড়াহুড়ো করে। খাবার বানানো, খাওয়ানো, পোশাক পরানো, তৈরি করা, টিফিন গুছিয়ে দেওয়া। তাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ঘর থেকে। পায়ে হেঁটেই তাদের পৌঁছে  দেন স্কুলে। তার পরে সেখান থেকে হাঁটেন আরও দু’মাইল। পৌঁছন নিজের কাজের জায়গায়। হাড়ভাঙা পরিশ্রম বেলা অবধি। রাশি রাশি বাসন ধোয়ার কাজ করতে হয় তাঁকে। কাজ শেষ করে, মেয়েদের স্কুল থেকে নিয়ে ফিরে আসেন বাড়ি। ফের বাড়ির কাজ সারতে হয়।

এভাবেই দিন কাটে তাঁর, যেমন কাটে আর পাঁচ জন সিঙ্গল মাদারের। কিন্তু তিনি কোনও দিনই ‘আর পাঁচ জন’ ছিলেন না। তিনি বারবার এভারেস্ট ছুঁয়ে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম তোলা মহিলা শেরপা। তবে ভাগ্যের এবং পরিস্থিতির ফেরে তাঁকে বাসন মেজে দিন গুজরান করতে হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে।

তার মধ্যেই আলো জ্বলে উঠল আরও একবার। মে মাসের ১২ তারিখে লাকপা শেরপা ফের আরোহণ করলেন এভারেস্ট। লাকপা বললেন, “আমি গত দু’বছর ধরেই চেষ্টা করছিলাম এভারেস্ট এক্সপিডিশনের। কোভিডের জন্য তা হয়ে ওঠেনি। আমি খুবই কঠিন সময় পার করেছি। আমার বাবা মারা গেলেন। মারা গেলেন আমার বাচ্চাদের বাবাও (২০১২ সালে ডিভোর্স হয়ে যায় লাকপা ও তাঁর স্বামীর)। এখনও যে আমি, আমার বাচ্চারা বেঁচে আছি, সুস্থ আছি, এতেই আমি খুশি। আমি জানতাম, একদিন আমি আবার এভারেস্ট যাবই। এই দশ নম্বর বার এভারেস্ট সামিট, এ যেন আমার গ্র্যাজুয়েশন করার মতো অনুভূতি।”

নেপালের মাকালু এলাকার নীচে ছোট্ট এক গ্রাম বালাখারকা। সেখানকারই অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে লাকপা নেপালের শেরপা সম্প্রদায়ের মহিলাদের মধ্যে রীতিমতো দৃষ্টান্ত। লাকপার বাবা ছিলেন পেশায় ইয়াক প্রতিপালক। পরে একটি ছোট লজ তৈরি করেন তিনি। অভিযাত্রীরা তাঁর লজে থাকতেন, খাওয়াদাওয়া করতেন। সেখানেই রান্নাবান্নার কাজ করতে শুরু করেন কিশোরী লাকপা।

ছোটবেলা থেকে অবশ্য পড়াশোনা করে ডাক্তার বা পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন লাকপা, কিন্তু অভিযানের গল্প শুনতে শুনতে, অন্য শেরপাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে পাহাড়ে যাওয়ার ইচ্ছে জন্মায় তার। এই ভাবেই এক বার বেরিয়ে পড়েছিলেন এভারেস্ট অভিযানে, পরিচিত কিছু শেরপাদের সঙ্গে। বেসক্যাম্প পর্যন্ত গিয়ে রান্নার কাজ করেছিলেন লাকপা। সেই শুরু। ভালবেসে ফেললে পাহাড়ে হাঁটতে, আর সঙ্গী শেরপারাও লক্ষ্য করলেন, এইটুকু মেয়ের মনের জোর দেখার মতো!

তার পরে আর থামা নেই। মাঝেমাঝেই বেরিয়ে পড়তেন ছোটখাটো নানা অভিযানে। পর্বতারোহণের প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও, শেরপারা হাতে ধরে পর্বতারোহণ শিখিয়েছিলে তাঁকে। তবে বড়সড় অভিযান করা হয়নি কখনও। সুযোগ মেলেনি। ২০০০ সালে, হঠাৎই সুযোগ আসে, নেপাল সরকার আয়োজিত উইমেন মিলেনিয়াম এক্সপিডিশনে অংশ নেওয়ার। গন্তব্য, এভারেস্ট। পরিবারের নানা বাধা পার করে পাড়ি দিয়েছিলেন লাকপা। ভেবেছিলেন, যা হবে দেখা যাবে।

শুধু দেখা গেল না, দেখল তামাম নেপালবাসী তথা বিশ্ববাসী। পর্বতারোহণ মহলকে চমকে দিয়ে সেই বারই নানা দেশের আরও পাঁচ জন মহিলা অভিযাত্রীর সঙ্গে ২৫ বছরের লাকপা শেরপা ছুঁয়ে ফেলেন এভারেস্ট। অপার একটা আকাশ খুলে গেল লাকপার সামনে। ৮৮৪৮ মিটার উঁচুতে দাঁড়িয়ে যে ঝকঝকে আকাশে গাল ছোঁয়ালেন তরুণী লাকপা, সে স্পর্শের মোহ আর ভাঙল না তাঁর। সেই সঙ্গে এ-ও ঠিক করে নিয়েছিলেন, সাগরমাতার টান তিনি ফেরাবেন না কখনও। বারবার আসবেন এই পথে। ছুঁয়ে দেখবেন হিমালয়ের শৃঙ্গদের।


কিন্তু তখনও লাকপা ভাবেননি, এই এভারেস্টেই বারবার আসা হবে তাঁর। কিন্তু প্রথম ভালবাসা যেমন আজীবন পিছু ছাড়ে না, লাকপা আর এভারেস্টের বন্ধনীও আলগা হল না তেমনই। তত দিনে ভাল আরোহী হিসেবে এবং সাহায্যকারী শেরপা হিসেবে বেশ নাম করে ফেলেছেন লাকপা। বহু মহিলা এভারেস্ট অভিযাত্রী টিমই চাইত, তাঁদের সঙ্গী হন লাকপা। লাকপাও যেতেন। ন’বার সফল এভারেস্ট অভিযান করা হয় তাঁর। এর মধ্যে এক বার তিনি আরোহণ করেন, দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়।

রেকর্ডের পরে রেকর্ড জমছিল লাকপার। নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। ২০০২ সালে মার্কিন পর্বতারোহী জর্জ দিজমার্সাকুকে বিয়ে করে তাঁর সঙ্গে আমেরিকার কানেক্টিকাটে পাড়ি দেন লাকপা। মা হন সন্তানের। তার পরেও তাঁরা দু’জনে নেপালে আসেন একাধিক বার, এভারেস্ট আরোহণ করতে। কিন্তু হঠাৎই সব বদলে যায় খুব দ্রুত।

পারিবারিক হিংসার শিকার হন লাকপা। স্বামীর হাতে নির্যাতিত হন একাধিক বার। ২০০৪ সালে এভারেস্ট অভিযানে গিয়ে, সেখানেও লাকপার গায়ে হাত তোলেন জর্জ। সকলের সামনেই তৈরি হয় চরম দুঃখজনক একটি উদাহরণ। ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে পরিস্থিতি। এর মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত হন জর্জ। তাঁর চিকিৎসা চালানোই কঠিন হয়ে পড়ে টাকার অভাবে, পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তাঁর দুর্ব্যবহার।

শেষমেশ ২০১২ সালে ডিভোর্স হয়ে যায় লাকপা-জর্জের। তিন সন্তানকে নিয়ে আলাদা হয়ে কানেক্টিকাটেরই একটি বাড়িতে থাকতে শুরু করেন লাকপা। চাকরি খুঁজতে শুরু করেন। কাজ নেন হোল ফুডস বলে একটি সংস্থায়। সেখানেই বাসন মাজার কাজ করেন তিনি। ২০২০ সালে ক্যানসারে ভুগে মারা যান জর্জ।


তবে এসবের মাঝে কোনওদিনই চাপা পড়েনি লাকপার মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রাকৃতিক অ্যাথলিট সত্ত্বা। বরং জীবনের একের পর এক সংগ্রাম তাঁকে আরও দৃঢ়চেতা করে তুলেছে। শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে নিরন্তর। ট্রেনিং করার সুযোগ নেই, পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার সংস্থান নেই।

এত সব সমস্যারর মাঝেও এভারেস্টের স্বপ্ন পিছু ছাড়েনি তাঁর। তবে সে স্বপ্নকে পরিহাস করেছে তাঁর ছেঁড়া জুতো, পুরনো হয়ে যাওয়া জ্যাকেট, ভাঙা আইসঅ্যাক্স। এমনকি তাঁর অক্সিজেন মাস্কটিও ৫০ বছরের পুরোনো। সেই মাস্ক পরেই জয় এল শেষমেশ।

পাহাড়চুড়োর শত আতঙ্ক জলভাতের মতো পার করে এসেছেন লাকপা। কখনও লড়েছেন খুম্বু আইসফলের বিশাল ফাটল থেকে নিজেকে বাঁচাতে, কখনও বা চরম প্রতিকূল আবহাওয়ায় এক পা-এক পা করে এগিয়েছেন শৃঙ্গের দিকে। সহ-অভিযাত্রীর দেহ সঙ্গে করে নীচে নামানোর মতো পরিস্থিতিও এসেছে পাহাড়ে। এত কিছু পার করে আসা লাকপা যে ফের বিজয়িনী হবেন, বারবার শিখর স্পর্শ করবেন, তাতে আর সংশয় কী।

এভারেস্ট ও লোৎসে সামিট হিমাচলের তরুণী বলজিতের, ২৪ দিনে চার ৮-হাজারি শৃঙ্গ ছোঁয়ার ইতিহাসখবর দ্য ওয়ালের /এনবিএস/২০২২/একে

news