১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর চীনের বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ইতিহাস লেখা হলো। হাজার হাজার মানুষ উত্তেজনা, আশা ও আগ্রহ নিয়ে স্কয়ারের দিকে ছুটছিল। সেই সময় মাও সে তুং ঘোষণা দেন, “গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হলো।” এই মুহূর্তটি যেন চীনের আকাশে নতুন সূর্যের আলো ছড়িয়ে দেয়। সেই থেকে শুরু হয় এক জাতির নতুন অধ্যায়।
তবে নতুন রাষ্ট্রের পথ সহজ ছিল না। বহু বছর ধরে চীন অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, গৃহযুদ্ধ, বিদেশি আগ্রাসন ও সামাজিক সমস্যার সঙ্গে লড়াই করেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ থেকে শহরের নাগরিক—সকলের জীবন ছিল চ্যালেঞ্জের মধ্যে। সেই দীর্ঘ ও জটিল যাত্রার মধ্য দিয়েই চীন আজ বিশ্বশক্তি হিসেবে উঠে দাঁড়িয়েছে। এর পেছনে রাজনৈতিক সংকট কাটানো, সামাজিক সংস্কার, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক কৌশল ছিল মূল চাবিকাঠি।
১৯১১ সালে চিং রাজবংশের পতনের পর চীনের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো বিপর্যস্ত হয়। জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, বিশেষ করে গ্রামে। শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা সীমিত ছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল। প্রাদেশিক যুদ্ধবাজ নেতাদের প্রভাব অত্যধিক থাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ক্ষমতার বিভাজন দেখা দেয়।
১৯২০-এর দশকে কুওমিনটাং (কেএমটি) শহর ও শিল্পকেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার শুরু করে, আর গ্রামীণ এলাকায় **চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শ্রমিক ও কৃষকের জন্য সমতার নীতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে জনসমর্থন বৃদ্ধি পায়।
১৯২৭ সালে শুরু হয় চীনের গৃহযুদ্ধ, যা গ্রামীণ চীনের জীবন আরও চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। ১৯৩৪-৩৫ সালে লংমার্চ সিসিপির নেতৃত্ব শক্তিশালী করে এবং বিপুল জনসমর্থন নিশ্চিত করে। দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধের সময় সিসিপি জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
১ অক্টোবর ১৯৪৯, তিয়েনআনমেন স্কয়ারে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ সমবেত হন। মাও সে–তুং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাও, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চৌ এনলাই দায়িত্ব নেন। নতুন চীনের প্রশাসনিক কাঠামোতে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় কংগ্রেস, সামরিক ও বিচার বিভাগ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
প্রথম কর্মসূচিতে ভূমি সংস্কার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সম্প্রসারণ, শিল্পায়ন এবং সামরিক সংহতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রায় ৫০ লাখ কৃষক নতুনভাবে জমি পান। প্রাথমিক শিল্পায়নে ১০০টি কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫ হাজার নতুন বিদ্যালয় এবং ৫ হাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপিত হয়।
সিসিপি সামাজিক নীতি প্রয়োগে নারীর ক্ষমতায়ন, শ্রমিক ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। স্কুলে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, কৃষির উৎপাদন বাড়ে এবং শিল্পায়ন কর্মসূচি গ্রামীণ ও শহুরে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।
গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও চীনের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়। ১৯৫০ সালে সোভিয়েত-চীন বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করে।
চীনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। ১৯৭১ সালে চীন জাতিসংঘে আসন পায়। ১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফর** দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন অধ্যায় সূচনা করে।
১৯৭৮ সালেদেং জিয়াওপিং ‘সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ’ নীতি চালু করেন। কৃষি খাতে পারিবারিক দায়দায়িত্ব ব্যবস্থা চালু হয়, যা খাদ্য উৎপাদন ও কৃষকের আয় বাড়ায়। শিল্পায়ন ও বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) তৈরি করা হয়। ১৯৮০-৯০-এর দশকে চীনের অর্থনীতি বছরে ৯-১০% হারে বৃদ্ধি পায়।
১৯৯০-এর দশক থেকে চীন সামরিক আধুনিকীকরণে জোর দেয়। বিমানবাহী রণতরী, সাইবার যুদ্ধ ও মহাকাশ কর্মসূচিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। ২০০৩ সালে চীন প্রথমবারের মতো নিজস্ব নভোচারী মহাকাশে পাঠায়।
প্রযুক্তি খাতে হুয়াওয়ে, লেনোভো, আলিবাবা ও টেনসেন্ট আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে।
২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ ঘোষণা করেন। ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে অবকাঠামোগত ও বাণিজ্যিক সংযোগ বাড়ানো এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য। ২০২০ সালের মধ্যে ১৪০টির বেশি দেশ এতে যুক্ত হয়, মোট বিনিয়োগ প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার।
সি চিন পিং বলেছেন, “বিশ্ব ভালো থাকলেই চীন ভালো থাকতে পারে। আর চীন ভালো করলে, বিশ্ব আরও ভালো হয়ে ওঠে।”
মাও থেকে সি—চীনের নেতৃত্ব চীনের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও বৈশ্বিক প্রভাব বৃদ্ধি করেছে। প্রযুক্তি, সামরিক শক্তি, শিল্পায়ন ও কূটনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে চীন আজ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি।
চীনের ইতিহাস এক প্রেরণার গল্প, যা শেখায়—পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও উদ্যমের মাধ্যমে বড় কিছু অর্জন সম্ভব।


