ভারত এবং ইসরায়েল তাদের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরও মজবুত করতে একটি নতুন সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনটাই জানিয়েছেন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিয়ন সা'আর।
এনডিটিভিকে দেওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারে ভারতকে একটি 'বৈশ্বিক পরাশক্তি' হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর কথায়, দুই দেশের গণতন্ত্রের সম্পর্ক এখন 'আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী'। তিনি জানান, প্রতিরক্ষা, অত্যাধুনিক উদ্ভাবন, সন্ত্রাস দমন থেকে শুরু করে বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রেই সহযোগিতা বাড়ছে।
নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি: দুই দেশের কৌশলগত অংশীদারিত্বের ঝলক
সা'আর নিশ্চিত করেছেন যে খুব শিগগিরই নতুন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত এমওইউটি সই হবে। তিনি বলেন, 'আমরা প্রতিরক্ষা, কৃষি এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এগোচ্ছি। তবে আমাদের সম্পর্ক আরও গভীর করার জন্য সব সময়ই আন্তরিক আগ্রহ রয়েছে।'
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস. জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকের পরপরই ইসরায়েলি মন্ত্রীর এই সাক্ষাৎকারটি মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অস্থির পরিস্থিতিতে ভারত-ইসরায়েল অংশীদারিত্বের কৌশলগত গুরুত্বকে নতুন করে সামনে নিয়ে এলো। বিশেষত, এই এমওইউ-এর খসড়াটি তেল আবিবে অনুষ্ঠিত ১৭তম ভারত-ইসরায়েল প্রতিরক্ষা সহযোগিতা যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডব্লিউজি) বৈঠকে চূড়ান্ত করা হয়েছে।
হামাসের হামলার পর মোদির ফোন: 'আমরা কখনো ভুলব না'
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামাসের বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলার প্রসঙ্গ টেনে সা'আর ভারতের দ্রুত নিন্দা জানানোর ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন, 'আমরা কখনো ভুলব না যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেই ভয়াবহ দিনে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ফোন করা প্রথম বিশ্বনেতা ছিলেন।' তাঁর ভাষায়, 'ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, এবং আমরা তা গভীরভাবে স্মরণ করি।'
গাজা শান্তি ও দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান: ইসরায়েলের কঠিন অবস্থান
গাজা শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে সা'আর বলেন, স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত পরিকল্পনাকেই একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, 'এটি একটি ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা, এবং ভারতের মতো এক বৈশ্বিক শক্তির এতে সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান প্রসঙ্গে ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী কঠোর অবস্থান নেন। তিনি স্পষ্ট জানান, 'আমরা এমন কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনে সম্মত নই যা আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে।' তাঁর মতে, গাজা, লেবানন ও ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক এখনো সক্রিয়, যা মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করছে।
সা'আর বলেন, 'ট্রাম্পের পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র বাধ্যতামূলক নয়; এটি পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।' হামাস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো গোষ্ঠীটির সামরিক ক্ষমতা ধ্বংস করা এবং গাজায় তাদের শাসনের পতন ঘটানো।
সন্ত্রাস দমনে যৌথ লড়াই: লস্কর-ই-তৈবা প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
সা'আর জোর দিয়ে বলেন, ভারত ও ইসরায়েল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একই রকম কষ্ট ও অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছে। তাঁর কথায়, 'সন্ত্রাস সর্বত্র বিদ্যমান, এবং ভারতের জনগণ দুর্ভাগ্যবশত এর ভয়াবহতা খুব ভালোভাবেই জানে।' তিনি জানান, লস্কর-ই-তৈবা-সহ বিভিন্ন সংগঠনকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে উভয় দেশ গোয়েন্দা তথ্য, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে নিবিড় সহযোগিতা করছে।
তিনি আরও জানান, প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা তথ্য আদানপ্রদানের জন্য একটি নতুন কাঠামো তৈরি হচ্ছে, যা দুই দেশের মধ্যে একটি প্রকৃত কৌশলগত অংশীদারিত্বকে প্রতিফলিত করবে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও IMEC করিডর
অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রসঙ্গে সা'আর বলেন, ২০২৩ সালের জি-২০ সম্মেলনে ঘোষিত 'ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর (আইএমইসি)' উদ্যোগটি পুনরুজ্জীবিত করতে ইসরায়েল কাজ করছে। তাঁর মতে, যুদ্ধের কারণে কিছুটা বিরতি এলেও এখন দুই দেশ পুনরায় অগ্রগতির জন্য প্রস্তুত।
আদানি গ্রুপের হাইফা বন্দরে বিনিয়োগকে তিনি 'পারস্পরিক আস্থার প্রতীক' হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, 'ইসরায়েলের উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেবল আমাদের জনগণকেই নয়, এখানে বিনিয়োগকারীদের সম্পদকেও সুরক্ষা দেয়।'
মোদি-নেতানিয়াহুর 'ঘনিষ্ঠ ও কৌশলগত' সম্পর্ক
সাক্ষাৎকারের শেষে সা'আর বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সম্পর্ক 'অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও কৌশলগত'। তিনি বলেন, 'তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা সবসময় উন্মুক্ত এবং ফলপ্রসূ। আমি আশা করি, তারা খুব শিগগিরই আবার বৈঠক করবেন।'
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, 'ভারত ভবিষ্যৎ, আর ইসরায়েল একটি আঞ্চলিক শক্তি—আমরা একসঙ্গে অসাধারণ কিছু অর্জন করতে পারব।' সা'আর আরও জানান, আগামী বছরের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) সম্মেলনে ইসরায়েল উচ্চ পর্যায়ে অংশগ্রহণ করবে, যা দুই দেশের ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি সহযোগিতার নতুন অধ্যায় সূচনা করবে।
