ভারত ভাগের সময়, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে কাশ্মীর উপত্যকায় বাংলা কিংবা পাঞ্জাবের মতো রক্তের নদী বয়নি।
এই সময় ৯৩.৭ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীর উপত্যকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও জম্মু প্রদেশের চিত্র ছিল একেবারে উল্টো।
জম্মুর রাজনৈতিক কর্মী আর দৈনিক কাশ্মীর টাইমসের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক বেদ ভাসিনের বয়স তখন মাত্র ১৮। ২০১৫ সালে মারা যাওয়া মি. ভাসিনের লেখা থেকে সেই ভয়ঙ্কর সময়ের জম্মুর ছবি উঠে আসে।
২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে তিনি ‘বিভাজনের অভিজ্ঞতা: জম্মু ১৯৪৭’ শীর্ষক গবেষণাপত্র পড়েন। সেখানে বলেন, “মাউন্টব্যাটেনের ভাগের পরিকল্পনা ঘোষণার পরপরই জম্মুতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে শুরু করে”।
“পুঞ্চে মহারাজা হরি সিংয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ আর কর বসানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন শুরু হয়। মহারাজার প্রশাসনের নির্মম দমন মানুষের রাগকে উসকে দেয়, আন্দোলন সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়”।
বেদ ভাসিন লেখেন, “মহারাজার প্রশাসন শুধু মুসলিমদের আত্মসমর্পণ করতে বলেনি, ডোগরা বাহিনীর অসংখ্য মুসলিম সৈন্য আর পুলিশ অফিসারদেরও ক্ষমতা কেড়ে নেয়, যাদের আনুগত্য নিয়ে সন্দেহ ছিল”।
তিনি বর্ণনা করেন কীভাবে জম্মুতে সাম্প্রদায়িক আগুন ছড়িয়ে পড়ে। “গুজব রটানো হয়, মুসলিমরা অস্ত্র তুলে হিন্দুদের ওপর হামলা করবে, এটা দিয়ে হত্যাযজ্ঞকে জায়েজ করা হচ্ছে”।
সেপ্টেম্বরের শেষে বিসনা, আরএসপুরা, আখনুরের মতো সীমান্ত এলাকা থেকে লাখো মুসলিম পাকিস্তানের শিয়ালকোটে পালিয়ে যান। পাশের পাঞ্জাবে দাঙ্গার আতঙ্ক সীমান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
“উধমপুর জেলায়, বিশেষ করে উধমপুর, চেনানি, রামনগর আর রিয়াসিতে বিপুল মুসলিম হত্যা হয়। ভাদেরওয়াহতে (উধমপুর থেকে ১৫০ কিমি দূরে) অনেক মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার শিকার হন”।
মি. ভাসিনের মতে, এই হত্যায় আরএসএস সদস্যরা মুখ্য ভূমিকা নেয়, সাহায্য করে সশস্ত্র শিখ শরণার্থীরা—“যারা তলোয়ার হাতে জম্মুর রাস্তায় ঘুরত”।
উধমপুর-ভাদেরওয়াহ দাঙ্গার কিছু নেতা পরে ন্যাশনাল কনফারেন্সে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হয়। ছাম্ব, দেবা বাটালা, মানুসার, আখনুরের মুসলিমদের হত্যার খবর আসে, অনেকে জম্মুর অন্য অংশে পালান।
কাঠুয়া জেলায় মুসলিম গণহত্যা, নারীদের অপহরণ-ধর্ষণ হয়।
প্রশাসনের মনোভাব নিয়ে মি. ভাসিন বলেন, “শান্তি ফেরানোর বদলে মহারাজার প্রশাসন সাম্প্রদায়িক গুন্ডাদের সাহায্য করে, অস্ত্র দেয়”।
মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার বাইরে থাকা অনেক মুসলিমকে দাঙ্গাকারীরা নৃশংসভাবে মারে। শহরে কারফিউ থাকলেও দাঙ্গাকারীরা অস্ত্র-গোলা নিয়ে গাড়িতে ঘোরে।
বেদ ভাসিন বলেন, “মুসলিমদের চলাচল বন্ধ করতেই কারফিউ”।
তালাব খাতিকানে মুসলিম
দের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়, তারপর নির্বিচার হত্যা। তাদের প্রথমে যোগী গেট পুলিশ লাইনে (এখন দিল্লি পাবলিক স্কুল) নেওয়া হয়।
নিরাপত্তার বদলে বলা হয়, পাকিস্তানে চলে যান। প্রথম ব্যাচে ৬০টা লরিতে হাজার হাজার মুসলিমকে শিয়ালকোটে পাঠানো হয়।
বেদ ভাসিনের ভাষায়, “লরিগুলো সেনার নজরে ছিল। কিন্তু শহরের উপকণ্ঠে চাট্টায় পৌঁছতেই আরএসএস-শিখ উদ্বাস্তুরা লরি দখল করে, যাত্রীদের টেনে নামিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে”।
সেনারা হত্যায় যোগ দেয় কিংবা দর্শক থাকে। গণহত্যার খবর গোপন রাখা হয়। পরদিন আরেক ব্যাচের একই পরিণতি।
যারা বেঁচে শিয়ালকোট পৌঁছান, তারা ভয়ঙ্কর গল্প বলেন।
প্রশাসন নিজেদের ভূমিকা অস্বীকার করে, জনসংখ্যা পরিবর্তনের পরিকল্পনাও অস্বীকার করে। কিন্তু মি. ভাসিন ভিন্ন মত দেন।
তৎকালীন এক কর্মকর্তা তাকে সতর্ক করেন, “আমি তোমাকে জেলে পাঠাতে পারতাম। কিন্তু তুমি ক্ষত্রিয়, আমার আত্মীয় আছে, তাই উপদেশ দিচ্ছি। এখন শান্তি কমিটির সময় নয়”।
“হিন্দু-শিখদের মুসলিম সাম্প্রদায়িকদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। আমরা হিন্দু-শিখ ডিফেন্স কমিটি গঠন করেছি। এটাকে সমর্থন করো”।
কর্মকর্তা প্রশিক্ষণের কথা বলেন। মি. ভাসিন লেখেন, “রেহারিতে হিন্দু-শিখ ছেলেরা ৩০৩ রাইফেলের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে আরএসএস যুবাদের সঙ্গে”।
হতাহতের সঠিক সংখ্যা অজানা, অনুমান ২০ হাজার থেকে ২ লাখ ৩৭ হাজার। প্রায় ৫ লাখ মানুষ পাকিস্তানে পালান। জম্মুতে মুসলিম অনুপাত বদলে যায়।
মি. ভাসিন স্মরণ করেন, মেহেরচাঁদ মহাজন (তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী) হিন্দু প্রতিনিধিদের বলেন, “ক্ষমতা জনগণের হাতে, সমতা দাবি করো”। জনসংখ্যার বৈষম্য প্রশ্নে রামনগর জঙ্গলের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “জনসংখ্যার গঠনও বদলাতে পারে”।
সাঈদ নাকভি ‘বিয়িং দ্য আদার: মুসলিমস ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে লেখেন, ১৯৪১ সালে জম্মু প্রদেশে মুসলিম ১২ লাখের বেশি, মোট জনসংখ্যা ২০ লাখ। জম্মু জেলায় মোট ৪.৫ লাখ, মুসলিম ১.৭ লাখ। রাজধানী জম্মুতে ৫০ হাজার, মুসলিম ১৬ হাজার।
কাশ্মীর টাইমসের নির্বাহী সম্পাদক অনুরাধা জামওয়াল বলেন, দেশভাগে জনতাত্ত্বিক গঠন বদলের চেষ্টা হয়। ১৯৪৭ গণহত্যায় জম্মু জেলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামে শুধু হিন্দু-শিখ থাকে।
১৯৪১-এ জম্মু জেলায় মুসলিম ১,৫৮,৬৩০ মোট ৪,২৮,৭১৯-এর ৩৭%। ১৯৬১-এ মোট ৫,১৬,৯৩২-এ মুসলিম ৫১,৬৯৩ ১০%।
‘ক্যালকাটা স্টেটসম্যান’ সম্পাদক ইয়ান স্টিফেন্স ‘পাকিস্তান’ বইয়ে লেখেন, পূর্ব পাঞ্জাব-পাতিয়ালায় ১১ সপ্তাহের নৃশংসতায় ২ লাখ মুসলিম নিখোঁজ, বাকিরা পশ্চিম পাঞ্জাবে পালান।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৯৫১ সালের ৫৩৪ নম্বর সভায় বলা হয়, মহারাজা ডোগরা বাহিনী, হিন্দু-শিখদের সাহায্যে ২,৩৭,০০০ মুসলিম নির্মূল কিংবা পাকিস্তানে তাড়িয়ে দেন টাইমস অফ লন্ডন, ১০ অক্টোবর ১৯৪৮।
এটা পাঠান আক্রমণের ৫ দিন আগে, ভারতে যোগের ৯ দিন আগে। হোরেস আলেকজান্ডার ‘দ্য স্পেক্টেটর’-এ ১৬ জানুয়ারি ১৯৪৮ ২ লাখ মুসলিম নিহতের কথা বলেন।
বেদ ভাসিন বলেন, তালাব খাতিকান-কনক মান্ডিতে মুসলিম বেশি, হিন্দুরা কম। মহারাজার সেনা হিন্দু বাড়িতে বসে মুসলিমদের গুলি করে। আরএসএস-সংশ্লিষ্টরা শিশু-নারীদেরও রেহাই দেয়নি, ধর্ষণ-হত্যা করে।
তবে মুসলিমদের মধ্যে ভাগ ছিল। মহারাজার পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া ধনী মুসলিমরা নিরাপদ, দরিদ্ররাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
১৯৪৭ সালের ২৪ অক্টোবর করাচির ‘ডেলি গেজেট’-এ কাশ্মীর টাইমসের হিন্দু সম্পাদক জি কে রেড্ডি লেখেন, “নিরস্ত্র মুসলিমদের বিরুদ্ধে ডোগরাদের উন্মাদ নৃশংসতা যে কাউকে লজ্জায় ফেলবে। আমি দেখেছি সৈন্যরা পাকিস্তান যাওয়া শরণার্থীদের গুলি করে টুকরো টুকরো করছে...”।
“আমার হোটেল রুম থেকে এক রাতে ২৬টা গ্রাম পোড়ার আগুন গুনেছি, শরণার্থী ক্যাম্প থেকে সারা রাত অটোমেটিক অস্ত্রের শব্দ”।
ব্রিটিশ কূটনীতিক সিবি ডিউক অক্টোবরে পরিদর্শনে একই বলেন।
মহাত্মা গান্ধী ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ জম্মু নিয়ে বলেন সাঈদ নাকভি উদ্ধৃত, “হিন্দু, শিখ আর বাইরের লোকেরা মুসলমানদের মেরেছে। দায়ী কাশ্মীরের মহারাজা”।
মি. ভাসিন বলেন, জম্মুতে হিংসা একতরফা ছিল না। রাজৌরি, মিরপুর, পাক-শাসিত এলাকায় হিন্দু-শিখদেরও গণহত্যা হয়। কিন্তু আরএসএস-চালিত মুসলিম গণহত্যার পেছনে প্রশাসনের স্পষ্ট সমর্থন ছিল।
আমস্টার্ডাম ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের ফেলো ইদ্রিস কান্ট বলেন, ডোগরা সরকার নথি ধ্বংস করে গণহত্যা চাপা দিয়েছে।
‘দ্য হিস্টোরিক্যাল রিয়েলিটি অফ দ্য কাশ্মীর ডিসপিউট’ লেখক পিজি রসুল বলেন, নেহরু-শেখ আবদুল্লাহ জম্মুতে মুসলিম প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ‘মর্মান্তিক ঘটনা’ শুনে নীরব ছিলেন। “তারা ভেবেছিলেন কাশ্মীর হারালেও জম্মুতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা রাখতে হবে”।
বেদ ভাসিন বলেন, মহারাজার ভীম্বের সফরের পর পুঞ্চের পালান্দারি, বাগ, সুধৌতিতে গণহত্যা হয়। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়া সৈন্যরা মহারাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
এই হত্যাকাণ্ড ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আর কাশ্মীর সংঘাতের সূচনা করে। জম্মু গণহত্যার ৫ দিন পর উপজাতি মিলিশিয়া কাশ্মীর আক্রমণ করে। ডোগরা সেনা পিছু হটে। হরি সিং ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাক্সেশন সই করেন, দিল্লি সেনা পাঠায়। কয়েক সপ্তাহের লড়াই প্রথম ভারত-পাক যুদ্ধে রূপ নেয়। ১৯৪৮ জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি।
জম্মু-কাশ্মীর দুই দেশে ভাগ হয়। তবু দুই পাশের কাশ্মীরিরা ৬ নভেম্বর এই গণহত্যা স্মরণ করে।
Kashmir
