নির্বাচনে জয়ের পর মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) বিজয় ভাষণে মামদানি সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে বলেন, “ডোনাল্ড ট্রাম্প, আমি জানি আপনি দেখছেন—আপনার জন্য আমার চারটি শব্দ আছে: শব্দের আওয়াজ বাড়ান।”

তার এই মন্তব্যের কিছুক্ষণ পরই ট্রাম্প নিজের সোশ্যাল মিডিয়া ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লেখেন, “...এবং এখান থেকেই শুরু হচ্ছে!”

এরপরই ট্রাম্প ৩৪ বছর বয়সী এই তরুণ নেতাকে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির “কমিউনিস্ট ভবিষ্যৎ” বলে কটাক্ষ করেন। নির্বাচনের আগেই তিনি মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রাক্তন গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমোকে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন—যদি নিউ ইয়র্কবাসী মামদানিকে ভোট দেয়, তবে তিনি শহরের তহবিল বন্ধ করে দেবেন। মামদানির জয়ের পরদিনই ট্রাম্প বলেন, “মানুষ এখন নিউ ইয়র্ক থেকে পালাতে শুরু করবে।”

এটাই প্রথম নয়, যে ট্রাম্প নিউ ইয়র্ক শহরের নীতিতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছেন। অতীতে তিনি অভিবাসন অভিযান বাড়ানো, যানজট নিরসনের তহবিল বন্ধ করা সহ বিভিন্ন পদক্ষেপে শহর প্রশাসনের বিপক্ষে গিয়েছেন।

কিন্তু মামদানি দৃঢ় কণ্ঠে জানান, “ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশ্বাসঘাতকতায় ক্লান্ত এই দেশকে যদি কেউ জাগিয়ে তুলতে পারে, তবে সেটি সেই শহরই, যেটি তাকে (ট্রাম্পকে) জন্ম দিয়েছে।”

ট্রাম্প প্রশাসন আগেও ডেমোক্র্যাট-শাসিত শহরগুলোর ওপর কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে—ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন থেকে শুরু করে অভিবাসন নীতিতে কঠোরতা আরোপ পর্যন্ত। এদিকে, ট্রাম্প ইতিমধ্যেই নিউ ইয়র্কসহ বড় শহরগুলোর অবকাঠামো প্রকল্পে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলারের ফেডারেল তহবিল স্থগিত করেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প যদি আরও ফেডারেল তহবিল কমিয়ে দেন, তাহলে মামদানির জীবনযাত্রার খরচ কমানোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে।

গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী পরিচয়ের মামদানি নির্বাচনী প্রচারণায় বিনামূল্যে দ্রুত বাস পরিষেবা, ভাড়া স্থগিতকরণ, সর্বজনীন শিশু যত্ন এবং শহর পরিচালিত মুদি দোকান চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুলিয়ান জেলাইজার বলেন, “বাস্তবতা হলো—নির্বাচিত মেয়রকে ট্রাম্পের আক্রমণের প্রতিক্রিয়াতেই তার বেশি শক্তি ব্যয় করতে হবে, যা তার নীতিগত লক্ষ্যকে পিছিয়ে দিতে পারে।”

ফেডারেল তহবিল সংকট ও কর পরিকল্পনা
নিউ ইয়র্ক সিটি বছরে প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন ডলার ফেডারেল তহবিল পায়, যা শহরের মোট বাজেটের ৭ শতাংশ। এই অর্থ আবাসন, শিক্ষা, জরুরি সেবা এবং নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর খাদ্য সহায়তায় ব্যবহৃত হয়।
মামদানি ধনী কর্পোরেশন ও শীর্ষ এক শতাংশ আয়কারী নাগরিকের ওপর কর বাড়িয়ে অতিরিক্ত ১০ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব সংগ্রহের প্রস্তাব দিয়েছেন, তবে এর জন্য রাজ্যের গভর্নরের অনুমোদন দরকার।

বর্তমান গভর্নর ক্যাথি হোচুল এখনো এই পরিকল্পনা নিয়ে নীরব, আর রিপাবলিকান প্রার্থী এলিস স্টেফানিক ইতিমধ্যেই রাজ্যের শীর্ষ পদে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

ন্যাশনাল গার্ড ও অভিবাসন অভিযান
বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, ট্রাম্প চাইলে নিউ ইয়র্কে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করতে পারেন, যেমন তিনি লস অ্যাঞ্জেলেস ও ওয়াশিংটন ডিসিতে করেছিলেন। মামদানি ইতিমধ্যেই বলেছেন, এমন পরিস্থিতিতে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হবেন।

একই সঙ্গে অভিবাসন অভিযানও আরও কঠোর হতে পারে। অভিবাসীবান্ধব শহর হিসেবে পরিচিত নিউ ইয়র্কে আইসিই (ICE) অভিযানে শত শত অভিবাসীকে আটক করা হয়েছে। তবে মামদানি পরিষ্কার জানিয়েছেন, “নিউ ইয়র্ক থাকবে অভিবাসীদের শহর—অভিবাসীদের দ্বারা নির্মিত, চালিত, আর এখন এক অভিবাসীর নেতৃত্বে।”

তিনি ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে বলেন, “রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প, আমাদের কাছে পৌঁছাতে হলে আপনাকে আমাদের সবার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।”

‘ট্রাম্প-প্রুফ’ নিউ ইয়র্ক পরিকল্পনা
নির্বাচনের পর মামদানি ঘোষণা করেছেন, শহরের আইনি প্রতিরক্ষা জোরদার করতে তিনি অতিরিক্ত ২০০ আইনজীবী নিয়োগ করবেন, যাতে ট্রাম্প প্রশাসনের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের জবাব শক্তভাবে দেওয়া যায়।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বব শাপিরো মনে করেন, “মামদানি সময় নিয়ে পরিকল্পনা করছেন। তিনি জানেন—ট্রাম্পের সঙ্গে লড়াই কখন এবং কীভাবে শুরু করলে তা রাজনৈতিকভাবে তাকে শক্তিশালী করবে।”

হার্ভার্ডের অধ্যাপক জাস্টিন বেনেডিক্টিস-কেসনার বলেন, “মামদানি বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদ। যদি ট্রাম্পের সঙ্গে সংঘাত তার নীতিগত লক্ষ্য এগিয়ে নিতে সাহায্য করে, তবে তিনি তা ব্যবহার করবেন।”

নিউ ইয়র্কের নতুন মেয়রের বার্তা স্পষ্ট—ট্রাম্প যতই বাধা দিন, শহরটি তার পথে এগিয়ে যাবে, “অভিবাসীদের হাতে গড়া সেই নিউ ইয়র্ক”-এর আদর্শ নিয়েই।

 

news