মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বোমাবর্ষণ বন্ধের আহ্বান উপেক্ষা করে আবারও গাজায় ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। স্থানীয় সময় শনিবারের এই বিমান হামলায় অন্তত ৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে চিকিৎসা সূত্র।
এই হামলা এমন সময় হলো, যখন হামাস ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার কয়েকটি ধাপে সম্মতি জানিয়েছে। তবুও, অবরুদ্ধ গাজায় আগ্রাসন থামায়নি ইসরায়েল।
নিহতদের মধ্যে অন্তত ৪৫ জন গাজা শহরের, যেখানে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরায়েলি সেনারা ভয়াবহ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এই হামলায় হাজার হাজার মানুষ দক্ষিণের জনাকীর্ণ এলাকায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
গাজা শহরের তুফাহ এলাকায় এক আবাসিক ভবনে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ১৮ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। আশপাশের কয়েকটি ভবনও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে সাতজন শিশু রয়েছে, যাদের বয়স মাত্র দুই মাস থেকে আট বছরের মধ্যে।
এছাড়া দক্ষিণ গাজার আল-মাওয়াসি এলাকায় একটি বাস্তুচ্যুত শিবিরেও ইসরায়েলি হামলা হয়েছে। সেখানে দুই শিশু নিহত এবং কমপক্ষে আটজন আহত হয়েছেন।
আল-মাওয়াসিকে “নিরাপদ মানবিক অঞ্চল” বলা হলেও, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বারবার এ অঞ্চলেই হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
আল জাজিরার প্রতিবেদক হিন্দ খোদারি জানিয়েছেন, নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরসহ মধ্য গাজার বিভিন্ন স্থানে বিমান হামলা হয়েছে। “হাসপাতালগুলো এখন ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসা দিতে সম্পূর্ণ অক্ষম। উত্তর গাজার কয়েকটি হাসপাতাল এখনও কোনোভাবে চালু থাকলেও জ্বালানি সংকটে কার্যক্রম প্রায় বন্ধ,” তিনি বলেন।
ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির আহ্বান
শনিবার ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, “আমি বিলম্ব মেনে নেব না। হামাসকে এখনই বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে এবং যুদ্ধ শেষের আলোচনায় অংশ নিতে হবে। সবাই ন্যায্য আচরণ পাবে।”
ট্রাম্প দাবি করেছেন, ইসরায়েল ইতোমধ্যেই এক প্রাথমিক ‘প্রত্যাহার লাইনে’ সম্মত হয়েছে এবং বিষয়টি হামাসকেও জানানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “হামাস নিশ্চিত করলেই যুদ্ধবিরতি সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হবে, বন্দী বিনিময় শুরু হবে এবং পরবর্তী পর্যায়ের প্রত্যাহারের প্রস্তুতি নেওয়া হবে।”
ট্রাম্পের প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রায় ২,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দীর বিনিময়ে ইসরায়েলি জিম্মিদের ফিরিয়ে দেওয়ার কথা রয়েছে।
হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, এই আলোচনার কারিগরি দিক চূড়ান্ত করতে ট্রাম্প তার দূত স্টিভ উইটকফ ও জ্যারেড কুশনারকে মিশরে পাঠাচ্ছেন। সেখানে সোমবার ইসরায়েল ও হামাস প্রতিনিধিদলও আলোচনায় যোগ দেবে।
জেরুজালেমে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, মিশরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গাজার বাকি বন্দীদের মুক্তির সময়সীমা নির্ধারণে কাজ চলছে। তিনি বলেন, “ট্রাম্পের প্রস্তাব বা সামরিক পদক্ষেপ—যেভাবেই হোক হামাসের সামরিকীকরণ শেষ করতে হবে।”
হামাসের প্রতিক্রিয়া
অন্যদিকে, হামাস গাজায় চলমান এই হামলাকে “নেতানিয়াহুর মিথ্যাচারের প্রমাণ” বলে আখ্যা দিয়েছে।
সংগঠনটি বলেছে, “ইহুদি দখলদার সেনাবাহিনী গাজায় আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে।” হামাস ইসলামী ও আরব দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে—“আমাদের জনগণকে সুরক্ষা ও ত্রাণ দিতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিন।”
কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আদনান হায়াজনেহ বলেন, “হামাস নিশ্চিত হতে চায়, ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্তি দিলে ট্রাম্পের পুরো পরিকল্পনাই কার্যকর হবে। এর মধ্যে গাজার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা সম্পর্কেও নিশ্চয়তা দরকার।”
তিনি আরও বলেন, “এই পরিকল্পনাটি হামাসের জন্য প্রায় আত্মসমর্পণের মতো। তারা হয়তো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দর-কষাকষি চালিয়ে যাবে।”
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত মৃতের সংখ্যা এই হিসাবের অন্তত তিনগুণ হতে পারে।


