দুই বছরের ভয়াবহ যুদ্ধের অবসান ঘটেছে গাজায়। ইসরাইলি বাহিনীর লাগাতার বিমান হামলা ও কামানের গোলায় উপত্যকাটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। হাজার হাজার ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। শিশুদের খেলার মাঠ, হাসপাতাল, শপিং মল, এমনকি সরকারি কার্যালয়—কিছুই রক্ষা পায়নি দখলদার বাহিনীর হামলা থেকে।

গাজায় যারা বেঁচে আছেন, তারা এখন এক অকল্পনীয় বাস্তবতার মুখোমুখি। মা হারিয়েছেন সন্তানকে, ভাই হারিয়েছে বোনকে, স্বামী হারিয়েছে স্ত্রীকে। চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিশু, বৃদ্ধ—কেউই বেঁচে যাননি এই বর্বরতা থেকে। তবু শুক্রবার যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ধ্বংসস্তূপে ফিরে যাচ্ছেন বাস্তুচ্যুত গাজাবাসী, হারানো বাড়িঘর আর স্মৃতির সন্ধানে।

চুক্তি অনুযায়ী, ইসরাইল ইতোমধ্যে গাজার কিছু অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে।

যুদ্ধবিরতির পর গাজার মানুষদের ফেরার স্রোত

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির খবর ছড়িয়ে পড়তেই গাজার সবচেয়ে বড় শহর গাজা সিটির দিকে মানুষের বিশাল স্রোত দেখা যায়। কিছুদিন আগেই এই অঞ্চল ছিল ইসরাইলের সবচেয়ে বড় হামলার লক্ষ্যবস্তু।

শেখ রাদওয়ান জেলার ৪০ বছর বয়সী ইসমাইল জায়েদা বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ, আমার বাড়িটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু চারপাশ একেবারে ধ্বংস। প্রতিবেশীদের ঘর নেই, পুরো জেলা নিশ্চিহ্ন।”

আরেক অধিবাসী মাহদি সাকলা বলেন, “যুদ্ধবিরতির খবর শুনে আমরা স্বস্তি পেয়েছি। যদিও বাড়িঘর কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবুও ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়েই ফিরে আসাটা আমাদের কাছে মুক্তির মতো।”

চুক্তির শর্ত: জিম্মি বিনিময় ও সেনা প্রত্যাহার

ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, হামাসকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ২০ জন জীবিত ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে। এর বিনিময়ে ইসরাইল কারাগারে আটক ২৫০ জন ফিলিস্তিনি এবং যুদ্ধকালে আটক ১,৭০০ জনকে মুক্তি দেবে।

মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ জানিয়েছেন, ইসরাইল গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রথম ধাপ সম্পন্ন করেছে। জিম্মি বিনিময় প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তাবাহী শত শত ট্রাক গাজায় প্রবেশ করবে, যা লাখো বাস্তুচ্যুত মানুষকে সাহায্য করবে।

গাজার নিরস্ত্রীকরণে অটল ইসরাইল

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটলেও, ইসরাইল এখনো পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করবে না। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক ভাষণে বলেন, “গাজাকে অস্ত্রমুক্ত করা এবং হামাসকে নিরস্ত্র করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। প্রয়োজনে কঠিন পথেও তা অর্জন করা হবে।”

অন্যদিকে হামাসের নির্বাসিত নেতা খালিল আল-হাইয়া দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যস্থতাকারীরা যুদ্ধ সমাপ্তির নিশ্চয়তা দিয়েছেন। তবে ইসরাইলি বাহিনী গাজার সামরিক নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এখনো সতর্কতা জারি রেখেছে। হামাসও ঘোষণা করেছে, ইসরাইলের ফাঁকা করা এলাকাগুলোতে তারা নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করবে।

শান্তির পথে দীর্ঘ বাধা

এই চুক্তি এখন পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হলেও শান্তির পথে বাধা এখনো অনেক। জিম্মি বিনিময়ে যেসব ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে, তাদের তালিকা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। হামাস দাবি করছে, ইসরাইলি কারাগারে থাকা কিছু শীর্ষ নেতাকেও মুক্তি দিতে হবে।

এছাড়া ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার অনেক বিষয়ই এখনো অনির্ধারিত—বিশেষ করে যুদ্ধ শেষে গাজার শাসন কাঠামো ও হামাসের ভবিষ্যৎ ভূমিকা। যদিও হামাস নিরস্ত্রীকরণের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে, ইসরাইল এখনো সে বিষয়ে অনড়।

এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগামী রোববার মধ্যপ্রাচ্য সফরে যাচ্ছেন। তিনি মিশর বা ইসরাইলে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন বলে জানা গেছে।

দুই বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষে গাজায় ফিরেছে একটুখানি স্বস্তির হাওয়া। কিন্তু শান্তির স্থায়ী বাতাস বইতে এখনও অনেক দূর যেতে হবে।

 

news