অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে অন্তঃসত্ত্বা সোনালী খাতুন এবং তাঁর পরিবারকে গত জুনে বাংলাদেশে 'পুশব্যাক' করার ঘটনায় এবার এক নতুন মোড়। সোনালীর বাবা-মা গতকাল শনিবার ভারতের নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্তৃক প্রকাশিত ২০০২ সালের পশ্চিমবঙ্গ ভোটার তালিকায় তাঁদের নাম খুঁজে পেয়েছেন। এই শক্তিশালী প্রমাণ সামনে আসার পর সোনালীর পরিবার কেন্দ্রের কাছে প্রশ্ন তুলেছে— তাঁদের মেয়ে ও জামাইকে দেশে ফেরাতে আর কী কী প্রমাণ প্রয়োজন?
বীরভূম জেলার পাইকর গ্রাম থেকে সোনালীর বাবা ভদু শেখ মোবাইল ফোনে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন, "এখন আমাদের নাম তালিকায় পাওয়া গেছে। আমার অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে এবং তার পরিবারকে ঘরে ফেরানোর জন্য আর কী লাগবে? কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, এমনকি বাংলাদেশের একটি আদালতও তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এখনো কিছুই হচ্ছে না।"
সোনালীর মা জ্যোৎস্না বিবি মেয়ের স্বাস্থ্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, "ওখানে জেলে আমার মেয়ের কী ধরনের যত্ন হচ্ছে, আমরা জানি না। ওকে ফিরে এসে ভারতেই সন্তান প্রসব করতে হবে। আমরা ওর জন্য খুবই চিন্তিত।"
আইনজীবীর দাবি: নতুন তথ্যে মামলা আরও মজবুত, সন্তান জন্ম নিলেও সে ভারতীয়!
সোনালীর প্রতিনিধিত্বকারী আইনজীবী রঘুনাথ চক্রবর্তী নিশ্চিত করেছেন যে সোনালীর বাবা-মায়ের নাম বীরভূম জেলার মুরারাই বিধানসভা কেন্দ্রের ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় রয়েছে। পাইকর গ্রামের পাইকর প্রাথমিক বিদ্যালয়কে তাঁদের ভোটকেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
রঘুনাথ বলেন, "আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সোনালী এবং তাঁর পরিবার এখনো বাড়ি ফিরতে পারেনি, এটা দুঃখজনক। অন্তঃসত্ত্বা সোনালীর বিষয়টিও উদ্বেগের কারণ।" তিনি আরও দাবি করেন, এই নতুন তথ্য সোনালী খাতুন দম্পতির মামলাকে আরও শক্তিশালী করেছে। তাঁর মতে, সোনালীর সন্তান যদি বাংলাদেশেও জন্মগ্রহণ করে, তাহলেও সে 'বংশগতভাবে' ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবে।
বর্তমানে সোনালী, তাঁর স্বামী দানিশ এবং আট বছরের ছেলে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে কারাগারে বন্দী আছেন। প্রায় ২০ বছর ধরে দিল্লিতে আবর্জনা কুড়ানোর কাজ করা এই পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারটিকে দিল্লি পুলিশ আটক করার পর গত ২৬ জুন বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের নির্দেশ উপেক্ষিত, কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা
গত সেপ্টেম্বরে কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দেয় যে সোনালী ও তাঁর পরিবারের পাশাপাশি সুইটি বিবি (৩২) ও তাঁর দুই ছেলে—যাদের একই অভিযোগে একই সময়ে আটক করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল—সবাইকে এক মাসের মধ্যে ভারতে ফিরিয়ে আনতে হবে। যদিও কেন্দ্র সরকার এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে।
এদিকে, সোনালীর বাবা-মা হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও তাঁদের মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে "ব্যর্থ হওয়ায়" কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একটি আদালত অবমাননার মামলাও করেছেন। সোনালীসহ ছয়জনকে ফিরিয়ে আনার জন্য হাইকোর্টের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা ২৪ অক্টোবর শেষ হয়ে গেছে। এর আগে ৩ অক্টোবর বাংলাদেশের একটি আদালতও তাঁদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করে ভারতে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিল।
'জাতীয়তাবাদের নামে নৈতিক পতন'— কেন্দ্রকে তীব্র আক্রমণ তৃণমূলের
এই ঘটনা সামনে আসতেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্র সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছে। তৃণমূল দাবি করেছে, সোনালীর বাবা-মা ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নথিভুক্ত ভারতীয় নাগরিক। সোশ্যাল মিডিয়ায় এক পোস্টে তৃণমূল কংগ্রেস এটিকে নির্বাচনী তালিকার বিশেষ সংশোধন (এসআইআর)-এর নামে "বাংলার এবং এর জনগণের ওপর আক্রমণ" বলে অভিহিত করেছে।
তৃণমূল লিখেছে, "যে অন্তঃসত্ত্বা বাঙালি নারীর বাবা-মা ২০০২ সালের নির্বাচনী তালিকায় ভারতীয় নাগরিক হিসেবে নথিভুক্ত, তাঁকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে নির্বাসিত করা প্রশাসনিক ভুল নয়; এটি জাতীয়তাবাদের নামে একটি নৈতিক পতন।"
তৃণমূল সাংসদ এবং পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ বোর্ডের চেয়ারম্যান সমীরুল ইসলাম বলেন, "এটি কেন্দ্রের মুখে আরও একটি চপেটাঘাত।...শুধু দরিদ্র বাংলাভাষী পরিযায়ী হওয়ার কারণে তাঁদের অবৈধ বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে দিল্লি থেকে আটক করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।"
