রাশিয়া-আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধের সেই উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে, ১৯৬৫ সালে চীন যখন পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা করে, ঠিক তখনই ভারতের নন্দা দেবী চূড়ায় একটা গোপন আর ভয়ংকর অভিযান চালায় আমেরিকার সিআইএ। চীনের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নজরে রাখতে পর্বতের উপরে পারমাণবিক শক্তিতে চালিত একটা অ্যান্টেনা বসানোই ছিল এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য।
কিন্তু তুষারঝড়ে পুরো অভিযান ব্যর্থ হয়ে যায় আর প্রায় তিন দশক ধরে হিমালয়ের বরফের নিচে চাপা পড়ে থাকে একটা ভয়াবহ গোপন রহস্য – নিখোঁজ একটা প্লুটোনিয়ামযুক্ত পারমাণবিক জেনারেটর।
আমেরিকান বিমানবাহিনীর প্রধান জেনারেল কার্টিস লেমে একটা ককটেল পার্টিতে এভারেস্ট আরোহী ব্যারি বিশপের কাছ থেকে শোনেন যে, হিমালয়ের চূড়া থেকে তিব্বত আর চীনের গভীরে স্পষ্ট দেখা যায়। এরপরই সিআইএ বিশপকে দিয়ে একটা ছদ্মবেশী গোপন অভিযানের আয়োজন করায়।
‘সিকিম বৈজ্ঞানিক অভিযান’ নামে এই ছদ্মবেশী দলের নেতৃত্বে ছিলেন বিশপ। ভারতও চুপচাপ এই অভিযানে যোগ দেয়, কারণ ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর চীন নিয়ে তাদের বড় উদ্বেগ ছিল। তবে ভারতীয় দলের নেতা ক্যাপ্টেন এম এস কোহলি শুরু থেকেই সন্দেহ করছিলেন।
কোহলি পরে বলেন, এটা ছিল একদম বেকার অভিযান। সিআইএ প্রথমে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘায় ডিভাইস বসাতে চাইলে কোহলি বলেন, যারা সিআইএকে এই পরামর্শ দিচ্ছে তারা পুরোপুরি বোকা। শেষে তারা তুলনামূলক কম উঁচু নন্দা দেবীকে বেছে নেয়।
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে অভিযান শুরু হয়। আরোহীদের হেলিকপ্টারে উঁচুতে নিয়ে যাওয়ায় আবহাওয়ার সঙ্গে ঠিকমতো মানিয়ে নেওয়ার সময় পাননি। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তবে প্লুটোনিয়ামের উত্তাপে শেরপারা সেটা বয়ে নিতে একে অপরের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করত।
কোহলি স্মরণ করে বলেন, তখন আমরা বিপদের মাত্রা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। ১৬ অক্টোবর চূড়ার কাছে পৌঁছে ভয়ংকর তুষারঝড় শুরু হয়। ভারতীয় আরোহী সোনম ওয়াংয়াল বলেন, আমরা ৯৯ শতাংশ মরা ছিলাম। পেট খালি, পানি নেই, খাবার নেই, আর পুরোপুরি ক্লান্ত।
নিচের অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন কোহলি বেতারে নির্দেশ দেন, ক্যাম্প ফোর, এটা অ্যাডভান্স বেস। তোমরা শুনতে পাচ্ছ? ... জলদি ফিরে এসো... এক মিনিটও নষ্ট করো না। সরঞ্জাম সুরক্ষিত করো। নিচে নামো না।
বাধ্য হয়ে আরোহীরা ক্যাম্প ফোরের কাছে একটা বরফের খাঁজে সব সরঞ্জাম লুকিয়ে রেখে – যার মধ্যে নাগাসাকি বোমায় ব্যবহৃত প্লুটোনিয়ামের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ থাকা ১৩ কেজি ওজনের পারমাণবিক জেনারেটরও ছিল – প্রাণ বাঁচাতে নিচে নেমে আসেন।
পরের বছর দলটা ডিভাইস উদ্ধার করতে ফিরে আসে। কিন্তু সেটা উধাও, পুরো সরঞ্জামসহ বরফের খাঁজটা তুষারধসে ভেসে গেছে। কোহলির স্মরণে, সিআইএ অফিসাররা তখন বলেন, ওহ মাই গড, এটা খুব খুব গুরুতর হবে। এগুলো প্লুটোনিয়াম ক্যাপসুল!
পরে রেডিয়েশন ডিটেক্টর আর ইনফ্রারেড সেন্সর দিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয় কিন্তু ডিভাইসের কোনো চিহ্ন মেলেনি। আরোহী জিম ম্যাককার্থি বলেন, সেই অভিশপ্ত জিনিসটা খুব গরম ছিল। নিজের চারপাশের বরফ গলিয়ে ধীরে ধীরে নিচে ডুবে যেতে পারে।
এই অভিযান ব্যর্থ হয় আর গোপনীয়তা ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত থাকে। তারপর এক তরুণ সাংবাদিক হাওয়ার্ড কোন আউটসাইড ম্যাগাজিনে গল্পটা প্রকাশ করেন। তখন ভারতে বড় কেলেঙ্কারি হয়। বিক্ষোভকারীরা প্ল্যাকার্ড নিয়ে স্লোগান দেয়, সিআইএ আমাদের পানিতে বিষ মেশাচ্ছে।
চুপিচুপি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার আর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরার্জি দেশাই পরিস্থিতি সামলান। ব্যক্তিগত চিঠিতে কার্টার দেশাইয়ের ভূমিকার প্রশংসা করে এটাকে দুর্ভাগ্যজনক বলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে দুই দেশই চুপ থাকে।
এই প্লুটোনিয়াম এখনো গঙ্গায় মিশে যাওয়ার ভয় তৈরি করে। ৯২ বছরের জিম ম্যাককার্থি এখনো রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলেন, গঙ্গার
পানিতে প্লুটোনিয়াম ফেলে যাওয়া যায় না! জানেন কি, কত মানুষ গঙ্গার ওপর নির্ভর করে?
ক্যাপ্টেন কোহলি মৃত্যুর আগে আফসোস করে বলেন, সিআইএ আমাদের অন্ধকারে রেখেছিল। তাদের প্ল্যান ছিল বোকার মতো, কাজ ছিল বোকার মতো, যিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি বোকা। আর আমরা তাতে জড়িয়ে পড়েছি। চুপচাপ যোগ করেন, পুরো বিষয়টা আমার জীবনের একটা দুঃখের অধ্যায়। এজন্য নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না।
