বিশ্বখ্যাত আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক জন মের্শেইমারের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য তোলপাড় ফেলেছে। তার দাবি, যুক্তরাষ্ট্র এখন কোন বাহ্যিক শত্রুর মুখে পড়ে পতন হচ্ছেনা, বরং 'আমেরিকান সাম্রাজ্যের আত্ম-ধ্বংস' প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নিজেই নিজের পতন ঘটাচ্ছে।

'আমেরিকান সাম্রাজ্যের পতন ভেতর থেকেই শুরু হয়েছে'—মার্কিন চিন্তাবিদ মের্শেইমারের এই বক্তব্য দেশটির বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার অবস্থান কতটা পরিবর্তিত হচ্ছে, তারই ইঙ্গিত দেয়। পার্সটুডে সংবাদসংস্থার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, তার মতে আমেরিকা বাইরের হুমকির মুখে নয়, বরং তার নিজের বিশ্বব্যবস্থার কাঠামো থেকেই দুর্বল হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদী অহংকার ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা, যা একদিকে ইউরোপীয় মিত্রদের ওয়াশিংটন থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, অন্যদিকে ঠেলে দিচ্ছে একতরফা সামরিক নীতির দিকে।

এই মতটি যদিও কঠিন শোনায়, তবুও তা এমন এক বাস্তবতা তুলে ধরে যেখানে মার্কিন ক্ষমতার বহু ঐতিহ্যবাহী নির্দেশক দুর্বল হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র নিয়ম-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, যেখানে নিরাপত্তা চুক্তি ও বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু আজ বাস্তবতা হচ্ছে, এই ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বের অনেক অংশই শুধু ওয়াশিংটনের নীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেনা, পূর্বের উদীয়মান শক্তিগুলোও মার্কিন একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে নতুন নতুন কাঠামো গড়ে তুলছে।

মের্শেইমারের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এখন কূটনীতি বা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার চেয়ে 'হার্ড পাওয়ার' ও সামরিক শক্তির উপরই বেশি জোর দিচ্ছে। ৮০টিরও বেশি দেশে ৭০০ এর বেশি সামরিক ঘাঁটি এবং বিশাল প্রতিরক্ষা বাজেট থাকলেও, এই বিশাল উপস্থিতি এখন স্থিতিশীলতার বদলে হস্তক্ষেপবাদী নীতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রবণতা পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যেই ফাটল ধরিয়েছে এবং ঐতিহ্যবাহী জোটগুলোতে উত্তেজনা তৈরি করেছে, যা পশ্চিমা আধিপত্যের নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

মার্কিন শক্তির অর্থনৈতিক ভিতও এখন দুর্বল। বৈশ্বিক শিল্প উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ আগের তুলনায় কমেছে, অন্যদিকে চীনসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশ বেড়েছে। এই অর্থনৈতিক পরিবর্তনই আমেরিকান আধিপত্য পতনের একটি বড় কারণ। বিশ্ব এখন একক-কেন্দ্রিক ব্যবস্থা থেকে বহু-কেন্দ্রিক ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে, যেখানে চীন, রাশিয়া, ভারতের মতো উদীয়মান শক্তিগুলো তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে— যা স্পষ্ট প্রমাণ করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর পুরো বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেনা।

সাম্প্রতিক মার্কিন নীতির আরেকটি ফল হলো ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় কিছু ক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে গেছে, যা গুরুতর ফাটলের ইঙ্গিত দেয়। এই অবস্থা অন্যান্য দেশগুলোকে কৌশলগত স্বাধীনতা খোঁজা এবং মার্কিন নির্ভরতা কমানোর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে, এই প্রবণতা বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের অবস্থান দুর্বল করে মার্কিন আর্থিক প্রভাব কমিয়ে দিতে পারে।

মের্শেইমার আরও জোর দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় সার্বভৌমত্বের ধারণাকেই উপেক্ষা করে চলেছে। গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক পদে অদক্ষ লোক নিয়োগ বা গ্রিনল্যান্ড ইস্যুতে বিতর্ক—এসব আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়মকে অবজ্ঞারই প্রকাশ। এই আচরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দিয়েছে।

তার শেষ বক্তব্য, এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে আছে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাব। 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতির বদলে আসলে 'আমেরিকা অ্যালোন' নীতি কার্যকর হয়েছে, যা ডলারের মর্যাদা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যৌক্তিকতাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তার দৃষ্টিতে, বিশ্ব এখন একটি বারুদের গুদাম, আর যুক্তরাষ্ট্র সেই গুদামে আগুন নিয়ে দৌড়াচ্ছে—এটাই হলো ক্ষমতার মোহে কৌশলগত আত্মহননের পথ।

 

news