বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া-এর প্রয়াণ শুধু একজন নেত্রীর চলে যাওয়া নয়, এটি দীর্ঘ এক রাজনৈতিক অধ্যায়ের নিঃশব্দ সমাপ্তি। যিনি 'আপসহীন রাজনীতি'কে নিজের পরিচয়ে রূপ দিয়েছিলেন, যার নামের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আন্দোলন, সংঘাত, প্রতিরোধ ও ক্ষমতার লড়াই—তার রাজনৈতিক উপস্থিতি ঝাপসা হয়ে আসা মানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গভীর শূন্যতা তৈরি হয়েছে।

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ক্ষমতায় যেমন ছিলেন অবিচল, ক্ষমতার বাইরেও ছিলেন অনমনীয়। কোনো অবস্থান থেকে সরে আসা, রাজনৈতিক আপোস বা প্রতিপক্ষের সঙ্গে বোঝাপড়া—এগুলো কখনোই তার রাজনৈতিক চরিত্রের অংশ ছিল না। এই 'না-বাঁকা' অবস্থান তাকে দলের নেতাকর্মীদের কাছে এক সাহসের প্রতীকে পরিণত করলেও, রাষ্ট্র পরিচালনায় অচলাবস্থার জন্য তাকে দায়ী করার সুযোগও দিয়েছে বিরোধীদের।

২০০৮ সালের পর থেকে তার রাজনীতি আর ক্ষমতাকেন্দ্রিক ছিল না, তা রূপ নেয় প্রতিরোধের রাজনীতিতে। নির্বাচন বর্জন, আন্দোলনের ডাক, রাজপথের সংঘাত এবং একের পর এক মামলা—এই সবকিছুর ভারে তার রাজনৈতিক পরিসর ক্রমেই সঙ্কুচিত হতে থাকে। দীর্ঘ কারাবাস ও শারীরিক অসুস্থতা তাকে রাজপথ থেকে দূরে সরিয়ে দিলেও, দলীয় রাজনীতিতে তার নাম কখনোই গুরুত্ব হারায়নি। সিদ্ধান্তের শেষ কথা, রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা বা প্রতীকী নেতৃত্ব—সব কিছুর কেন্দ্রেই থেকেছেন খালেদা জিয়াই। এ কারণেই তার বিদায় বিএনপির জন্য শুধু নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রশ্ন নয়, বরং এক ধরনের অস্তিত্বের প্রশ্ন।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল 'আপস না করা'। সময়ের সঙ্গে রাজনীতি বদলেছে, কৌশল বদলেছে, কিন্তু তার অবস্থান বদলায়নি—এমনটাই বিশ্বাস করেন তার লক্ষ লক্ষ অনুসারী। আবার সমালোচকদের মতে, এই অনমনীয়তা-ই তাকে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে দেয়নি। তবুও ইতিহাস অস্বীকার করতে পারবে না যে, সামরিক শাসন-পরবর্তী বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পথচলায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার রাজনীতিতে খালেদা জিয়া ছিলেন এক অনিবার্য ও অপরিহার্য চরিত্র।

যদি আজ তার রাজনৈতিক বিদায় অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে থাকে, তবে এটি একটি অধ্যায়ের শেষ। সামনে বিএনপিকে নতুন নেতৃত্ব, নতুন কৌশল এবং হয়তো নতুন রাজনৈতিক দর্শনের পথে হাঁটতে হবে। কিন্তু যে রাজনীতি 'আপসহীনতার' প্রতীক হয়ে উঠেছিল, যে রাজনীতি ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক নেতৃত্বের উপর দাঁড়িয়ে ছিল—তার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা মোটেও সহজ হবে না।

খালেদা জিয়ার বিদায়ের সঙ্গে তাই একটি বড় প্রশ্নও থেকে যায়—বাংলাদেশের রাজনীতি কি আরও সমঝোতার পথে যাবে, নাকি সংঘাতের পুরোনো বৃত্তেই ঘুরপাক খাবে?

ইতিহাসে খালেদা জিয়া থাকবেন ভিন্ন ভিন্ন মূল্যায়নে—কারও কাছে গণতন্ত্রের নেত্রী, কারও কাছে সংঘাতের রাজনীতির মুখ। তবে একটি সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই: তিনি ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস অসম্পূর্ণ। তার বিদায় মানে একজন ব্যক্তির প্রস্থান নয়, বরং এক ধরনের রাজনীতির নীরব অবসান।

 

news