বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচনের ইতিহাসে এক অনন্য রেকর্ডের মালিক বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দেশের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যতবারই নির্বাচনে লড়েছেন, ততবারই জয়ী হয়েছেন। ফেনী থেকে বগুড়া, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম—তার জনপ্রিয়তা সারা দেশেই ছিল দৃশ্যমান। পাঁচটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবকটিতে জয়ী হওয়ার এই কীর্তি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সত্যিই বিরল।

নির্বাচনের সময়রেখা: ১৯৯১ থেকে ২০০৮

১৯৯১: প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যাত্রা
১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং সবকটিতে বিপুল ভোটে জয়ী হন।
ফলাফল: এই জয়ের মাধ্যমেই তিনি বাংলাদেশের প্রথম এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তখন বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।

১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি): স্বল্পস্থায়ী ষষ্ঠ সংসদ
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে অংশ নেয়। এই নির্বাচনেও খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে জয়ী হন।
আসন: ফেনী-১ ও ২, বগুড়া-৭, সিরাজগঞ্জ-২ ও রাজশাহী-২।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব: এই সংসদেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয় এবং মাত্র ১১ দিনের মাথায় তিনি পদত্যাগ করে গণতন্ত্রের জন্য নতুন একটি পথ তৈরি করেন।

১৯৯৬ (জুন): প্রতিকূলতা ছাপিয়ে জনপ্রিয়তা
১৯৯৬ সালের জুনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও খালেদা জিয়াকে পরাজিত করা যায়নি।
আসন: বগুড়া-৬, বগুড়া-৭, ফেনী-১, লক্ষ্মীপুর-২ ও চট্টগ্রাম-১।
ফলাফল: পাঁচটি আসনে লড়েই সবকটিতে জয়ী হন তিনি এবং সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০১: রেকর্ড ভোটে বিজয় ও তৃতীয় মেয়াদ
২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা চূড়ায় পৌঁছায়।
আসন: বগুড়া-৬, বগুড়া-৭, খুলনা-২, ফেনী-১ ও লক্ষ্মীপুর-২।
পরিসংখ্যান: এই নির্বাচনে তিনি প্রতিটি আসনেই রেকর্ড পরিমাণ ভোট পান। বিশেষ করে বগুড়া-৬ আসনে তিনি পেয়েছিলেন ২,২৭,৩৫৫ ভোট (৭৮.৯%)। এই জয়ের মাধ্যমেই তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।

২০০৮: আইনি সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জয়
২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন একজনের জন্য সর্বোচ্চ তিনটি আসনে লড়ার বিধান করলে তিনি বাধ্য হয়ে আসন সংখ্যা কমিয়ে আনেন।
আসন: বগুড়া-৬, বগুড়া-৭ ও ফেনী-১।
ফলাফল: বরাবরের মতো তিনটি আসনেই তিনি বিপুল ব্যবধানে বিজয়ী হন। বগুড়া-৬ আসনে পান ১,৯৩,৭৯২ ভোট এবং বগুড়া-৭ আসনে ২,৩২,৭১৬ ভোট।

কেন তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, খালেদা জিয়ার এই দীর্ঘদিন অজেয় থাকার পেছনে মূল কারণ ছিল তার 'আপসহীন' রাজনৈতিক অবস্থান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, 'খালেদা জিয়া কখনোই অসংযত কথা বলেননি। তাঁর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আচরণ ও দৃঢ়তা ভোটের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলত। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে টেলিভিশনে দেওয়া তাঁর একটি ভাষণ তৎকালীন সব রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টে দিয়েছিল।'

জনগণের প্রতি অটল অঙ্গীকার এবং দেশপ্রেম তাকে দল-মত নির্বিশেষে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এক অপরাজেয় নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

 

news