ক্লাব ফুটবলের কিংবদন্তি কোচ কার্লো আনচেলত্তি এবার নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির। রিয়াল মাদ্রিদে সবকিছু জয় করা এই ইতালিয়ান কোচ এখন ব্রাজিল জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়েছেন। আগামী ২৬ মে থেকে শুরু হচ্ছে তাঁর নতুন যাত্রা। বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিলের স্বর্ণযুগ কি ফিরিয়ে আনতে পারবেন ‘ডন’ কার্লো?

কার্লো আনচেলত্তি ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে এক কিংবদন্তি নাম। রিয়াল মাদ্রিদে দুই দফায় কোচিং করে তিনি জিতেছেন দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, দুটি কোপা দেল রে, এবং দ্বিতীয় দফায় দুটি লা লিগা শিরোপা। এছাড়া এসি মিলান, চেলসি, পিএসজি, এবং বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে অসংখ্য শিরোপা জিতেছেন। তবে চলতি মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের জন্য কঠিন সময় গেছে। রক্ষণভাগে সমস্যা, অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের ইনজুরি সত্ত্বেও তিনি দলকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে, লা লিগায় শীর্ষে লড়াইয়ে এবং কোপা দেল রে ও সুপার কোপার ফাইনালে নিয়ে গেছেন। এমন পারফরম্যান্স রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলের জন্য সাধারণ মনে হলেও, অন্য কোনো দল হলে এটি উচ্চ প্রশংসার দাবিদার হতো।

এবার আনচেলত্তি ব্রাজিল জাতীয় দলের কোচ হিসেবে নতুন অধ্যায় শুরু করছেন। ব্রাজিলের ইতিহাসে এটিই প্রথম কোনো বিদেশি কোচের নিয়োগ। বিশ্ব ফুটবলেও এমন উদাহরণ বিরল। আরও উল্লেখযোগ্য, বিশ্বকাপের ইতিহাসে কোনো দল বিদেশি কোচের অধীনে শিরোপা জিততে পারেনি। তবুও ব্রাজিল ২০২৩ সাল থেকে আনচেলত্তির জন্য অপেক্ষা করছিল। বারবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর অবশেষে বিশ্বকাপের এক বছর আগে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। ব্রাজিল এখন বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সংগ্রাম করছে। যদিও বিদায়ের আশঙ্কা নেই, তবে দলের বর্তমান ফর্ম বিশ্বকাপ জয়ের আশা জাগায় না। এমন কঠিন সময়ে আনচেলত্তি হাল ধরেছেন।

আনচেলত্তির সাফল্যের মূল চাবিকাঠি তাঁর ম্যান ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা। রিয়াল মাদ্রিদ, চেলসি, এসি মিলানের মতো ক্লাবে তিনি ফুটবল ইতিহাসের বড় বড় তারকাদের সামলেছেন। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, জিনেদিন জিদান, কাকার মতো খেলোয়াড়দের সঙ্গে কাজ করে তিনি ক্লাব ও খেলোয়াড় উভয়ের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করেছেন। ব্রাজিলের জন্য এই গুণটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিতের পর থেকে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন কোচদের সঙ্গে স্থিতিশীল সম্পর্ক গড়তে ব্যর্থ হয়েছে। রেমন মানেজেস, ফের্নান্দো দিনিজ, দরিভাল জুনিয়রের সঙ্গে বোর্ডের সম্পর্ক ভেঙে গেছে। আনচেলত্তির অভিজ্ঞতা এই অস্থিরতা কাটিয়ে দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে।

ব্রাজিল দলের মূল চ্যালেঞ্জ হলো তাদের প্রতিভাকে কাজে লাগানো। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রদ্রিগো গোয়েজ, এবং এডার মিলিতাও—এই তিন ব্রাজিলিয়ান তারকা রিয়াল মাদ্রিদে আনচেলত্তির অধীনে নিজেদের সেরাটা দিয়েছেন। কিন্তু জাতীয় দলে ভিনিসিয়ুসের পারফরম্যান্স হতাশাজনক। ৩৯ ম্যাচে মাত্র ৬ গোল তাঁর। আনচেলত্তি, যিনি রিয়ালে ভিনিসিয়ুসের বিধ্বংসী রূপ ‘আনলক’ করেছেন, তিনিই এখন ব্রাজিলের জন্য তাঁকে ফর্মে ফেরাতে পারেন। এছাড়া, নেইমার যদি ইনজুরি কাটিয়ে ফিরতে পারেন, তবে আনচেলত্তির কাজ আরও সহজ হবে। তাঁর নকআউট টুর্নামেন্টে সফলতার রেকর্ডও ব্রাজিলের জন্য আশার আলো।

আনচেলত্তির জন্য ব্রাজিলের কোচিং একটি সাধারণ চ্যালেঞ্জ নয়, বরং ফুটবল ইতিহাসে সর্বকালের সেরা কোচ হওয়ার সুযোগ। তিনি ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে শিরোপা জেতা একমাত্র কোচ এবং পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন। যদি তিনি ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জিততে পারেন, তবে তাঁর নাম সর্বকালের সেরা কোচের তালিকায় শীর্ষে উঠবে। ২০০২ সালে রিয়াল মাদ্রিদের জন্য লা ডেসিমা খরা কাটানোর মতো, ব্রাজিলের ২০০২ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকে শিরোপা খরা কাটাতে পারেন কি আনচেলত্তি? ব্রাজিল সমর্থকরা এই আশায় বুক বেঁধেছেন।

ব্রাজিল ফুটবলের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রতিভার অপচয় কাটিয়ে দলকে সাফল্যের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আনচেলত্তির মতো অভিজ্ঞ কোচই প্রয়োজন ছিল। ব্রাজিল কিংবদন্তি জিকো বলেছিলেন, “আনচেলত্তি আমাদের জন্য আদর্শ, কারণ তাঁকে সবাই শ্রদ্ধা করে।” তবে বিদেশি কোচ হিসেবে ব্রাজিলের প্রত্যাশা পূরণ করা সহজ হবে না। দলের তারকাদের সঠিকভাবে পরিচালনা, কৌশলগত শৃঙ্খলা এবং বিশ্বকাপের চাপ সামলানো—এই তিনটি চ্যালেঞ্জই নির্ধারণ করবে আনচেলত্তির সাফল্য।

কার্লো আনচেলত্তির হাতে এখন ব্রাজিল ফুটবলের ভাগ্য। রিয়াল মাদ্রিদে অসাধ্য সাধন করা এই কোচ কি ব্রাজিলের বিশ্বকাপ খরা কাটিয়ে সেলেসাওদের স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনবেন? তাঁর ম্যান ম্যানেজমেন্ট এবং নকআউট টুর্নামেন্টে সফলতার ইতিহাস আশা জাগায়।

news