ঘটনার মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই টাঙ্গাইলের স্কুলপড়ুয়া ২য় শ্রেণীর ছাত্রী তিশাকে (৯) গণধর্ষণসহ হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করেছে পিবিআই টাঙ্গাইল।  ডিসিস্ট তিশা (৯) টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল থানাধীন বন্দে ভাটপাড়া গ্রামের মোঃ আবু ভূইয়ার কন্যা। সে স্থানীয় শহীদ ক্যাডেট একাডেমির ২য় শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। 

ঘটনার দিন ২৬ মে ২০২২ তারিখ সন্ধ্যায় তিশাকে তাদের বসত ঘরের উত্তর পাশের রুমে ফ্যানের সাথে গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস লাগানো অবস্থায় পাওয়া গেছে মর্মে সংবাদ পাওয়া যায়।  উক্ত সংবাদের ভিত্তিতে টাঙ্গাইল পিবিআই পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সিরাজ আমীনের নির্দেশে একটি চৌকস ক্রাইমসিন টিম দ্রুততার সাথে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বাসাইল থানা পুলিশকে আইনি সহায়তা প্রদান পূর্বক প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে।  পিবিআই টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারে যে, ২৬ মে ২০২২ রোজ বৃহস্পতিবার সকাল আনুমানিক পৌনে ৭টার দিকে মোঃ আবু ভূইয়া (৩৮), পিতা-মৃত আদু ভূইয়া, সাং-বাসাইল ভাটপাড়া, থানা-বাসাইল, জেলা-টাঙ্গাইল এর স্ত্রী সম্পা বেগম তার ছেলে ৫ম শ্রেণীর ছাত্র মোঃ শুভ ভূইয়া (১২) এবং ২য় শ্রেণীর ছাত্রী মেয়ে তিশা আক্তারকে (৯) স্থানীয় শহীদ ক্যাডেট একাডেমিতে নিয়ে যায়। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মেয়ের স্কুল ও কোচিং শেষ হলে তিশা আক্তার বাড়ীতে চলে আসে।  মেয়ে তিশা দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে বসত ঘরের উত্তর পাশের রুমে একাই খেলা করছিল।  ছেলে শুভ বাড়ীতে ফেরার সময় পার হয়ে গেলেও বাড়ীতে না ফেরায় সম্পা বেগম বাড়ী হতে আনুমানিক ২০০/২৫০ মিটার দূরে রাস্তার পাশে থাকা ফজলুর দোকানের দিকে এগিয়ে যায় এবং দেখতে পায় যে, ছেলে শুভ ফজলুর দোকানে বসে আছে। তখন ছেলে শুভকে একটি জুস কিনে খেতে দেয় এবং পাশের অমত মেম্বারের দোকান হতে দুই প্যাকেট বিস্কুট ক্রয় করে এবং দোকানদারের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলে। উক্ত দোকানে ৪০/৪৫ মিনিট কথাবার্তা বলে ছেলে শুভকে নিয়ে বাড়ীতে আসে।  বাড়ীতে আসতে আনুমানিক আরো ৭/৮ মিনিট সময় লাগে। বাড়ীতে আসার পর ছেলে শুভ বসত ঘরের উত্তর পাশের রুমে প্রবেশ করে দেখতে পায় যে, মেয়ে তিশা খাটের উপর ফ্যানের সাথে গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস লাগানো অবস্থায় ঝুলে আছে। তিশার উক্ত অবস্থা দেখে ছেলে শুভ চিৎকার দিলে তার মা রুমে ঢুকে মেয়ে তিশাকে কোলে নিয়ে উপরের দিকে উঠায়। ছেলে শুভ পাশের রুম হতে একটি প্লাস্টিকের মোড়া এনে তার উপর দাড়িয়ে গলার ওড়নার গিট খুলে দেয়। শুভ ও তার মায়ের চিৎকারে আশেপাশের লোকজন এগিয়ে আসে এবং তিশাকে অচেতন অবস্থায় প্রথমে বাসাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। বাসাইল স্বাস্থ্য উপজেলা কমপ্লেক্সে তিশাকে (৯) ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, টাঙ্গাইল রেফার্ড করে, তারা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, টাঙ্গাইলে নিয়ে আসলে সেখানকার কর্তব্যরত ডাক্তার তাৎক্ষনিক তিশাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। পরবর্তীতে তিশার মা সম্পা বেগম মেয়েকে একটি এ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করলে পথিমধ্যে এ্যাম্বুলেন্সটি নষ্ট হওয়ায় মেয়ের অবস্থা আরও খারাপ হলে মেয়েকে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। তিশার পিতা গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সংলগ্ন একটি পোশাক কারখানায় কাটিং ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত থাকাবস্থায় সংবাদ পেয়ে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে মেয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৬ মে ২০২২ তারিখে ভর্তি করলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিশা ২৮ মে ২০২২ তারিখ বিকাল ৪টার দিকে মৃত্যুবরণ করে। সংবাদ পেয়ে বাসাইল থানা পুলিশ তিশার লাশের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত ও ময়না তদন্ত শেষে তিশার লাশ ২৯ মে ২০২২ তারিখ তিশার পিতা মোঃ আবু ভূইয়াকে বুঝিয়ে দেয়। পিবিআই টাঙ্গাইল উক্ত ঘটনার ছায়া তদন্ত অব্যাহত রাখে।

উক্ত ঘটনায় বাসাইল থানায় অপমৃত্যু মামলা নং-০৭, তারিখ ২৯ মে ২০২২ রুজু হয়। পরবর্তীতে বাসাইল থানা পুলিশ কর্তৃক ইং ০৪ জুন ২০২২ তারিখ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, টাঙ্গাইল হতে তিশা (৯) এর ময়না তদন্ত রিপোর্ট প্রাপ্ত হয়ে পর্যালোচনান্তে ময়না তদন্ত রিপোর্টে গনধর্ষনের আলামত থাকায় তিশার পিতা মোঃ আবু ভূইয়া (৩৮), পিতা-মৃত আদু ভূইয়া, সাং-বাসাইল ভাটপাড়া, থানা-বাসাইল, জেলা-টাঙ্গাইল এর অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাসাইল থানার মামলা নং ০১, তারিখ ০৪ জুন ২০২২ ইং, ধারা-নারী ও শিশু নিযার্তন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী/২০০৩) এর ৯(৩) রুজু হয়।  গণধর্ষনসহ হত্যা মামলাটি পিবিআই এর সিডিউলভূক্ত মামলা হওয়ায় পিবিআই টাঙ্গাইল জেলা মামলাটির তদন্তভার স্বউদ্যোগে গ্রহণ করে।  মামলাটির তদন্তভার গ্রহন করে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তথ্য প্রযুক্তি, ঘটনার পারিপার্শিকতা, বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (নিঃ) খন্দকার আশরাফুল কবিরের  নেতৃত্বে একটি চৌকস টিম অভিযান পরিচালনা করে ঘটনায় জড়িত ও ঘটনার পর হতেই পলাতক আসামীর অবস্থান জেনে সন্ধিগ্ধ আসামী (১) গোবিন্দ মন্ডল (১৯), পিতা-স্বপন মন্ডল, মাতা-জয়ন্তী রানী, সাং-বাসাইল ভাটপাড়া, থানা-বাসাইল, জেলা-টাঙ্গাইলকে বাসাইল পৌরসভাস্থ কাঁচা বাজারের সামনে হতে, (২) চঞ্চল চন্দ্র মন্ডল (১৭), পিতা-আনন্দ মন্ডল, মাতা-জোসনা রানী মন্ডল, সাং-বাসাইল ভাটপাড়া, থানা-বাসাইল, জেলা-টাঙ্গাইলকে বাসাইল থানাধীন কাঞ্চনপুর গ্রামস্থ সুনীল সরকারের বাড়ী হতে এবং (৩) বিজয় সরকার (১৬), পিতা-লালিত সরকার, মাতা-পুষ্পা রানী, স্থায়ী সাং-বেড়বাড়ী কুচলি পাড়া, থানা-সখিপুর, জেলা-টাঙ্গাইল, বর্তমান সাং-প্রযত্নে ধীরেন মন্ডল, গ্রাম-বাসাইল ভাটপাড়া, থানা-বাসাইল, জেলা-টাঙ্গাইলকে সখিপুর থানাধীন বেড়বাড়ী কুচলিপাড়া ললিত সরকারের বাড়ি হতে গ্রেফতার করা হয়। 

সন্ধিগ্ধ আসামীদের গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা উক্ত ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ডিসিস্টি তিশাকে পালাক্রমে ধর্ষণকরতঃ হত্যার উদ্দেশ্যে বাদীর ঘরের ফ্যানের সাথে গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখার বিষয়ে বিশদ বর্ণনায় প্রকাশ করে যে, ডিসিস্ট তিশা এবং আসামীদের বাড়ী পাশাপাশি। আসামী গোবিন্দ মন্ডল পেশায় একজন পিকআপ ড্রাইভার, বিজয় সরকার তার সহযোগী। আসামী চঞ্চল চন্দ্র মন্ডল একজন অটো মেকানিক। তারা পরস্পর বন্ধু। তিশার পরিবার এক সময় গাজীপুর কোনাবাড়ীতে ভাড়া বাসায় বসবাস করত। সেখানে শিশু তিশা নিজ প্রতিভায় নাচ শিখেছিল।  আনুমানিক ২ বছর পূর্বে তিশার বাবা তার স্ত্রী ছেলে-মেয়েকে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। তিশা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, পূজা অনুষ্ঠানে চমৎকার নাচ করতো, তার নাচের প্রতিভায় সবাই মুগ্ধ হতো। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় সে সকল অনুষ্ঠানে আসামীরা ও প্রায়ই উপস্থিত থাকতো। তখন হতে আসামীরা শিশু তিশার প্রতি বিকৃত যৌন লালসা তাদের মনে মনে পোষণ করতে থাকে এবং তিশাকে বিভিন্ন কায়দায় তারা উতক্ত্য করত। দুই মাস আগে তিশা আসামীদের এহেন উতক্ত্য করার বিষয়ে তার মাকেও জানিয়েছিল। কিন্তু আসামীরা বখাটে প্রকৃতির হওয়ায় তার মা তাদেরকে তেমন কিছু বলেনি। আসামীরা সব সময় তিশার মায়ের গতিবিধি অনুসরণ করতো, এবং তিশাকে বাড়িতে কখন একা পাবে, সেই চেষ্টায় লিপ্ত থাকতো। আসামীরা জানতে পারে যে, প্রতিদিন তিশার মা তিশাকে বাড়ীতে একা রেখে ছেলে শুভকে স্কুল ছুটির পর আগাইয়া আনতে যায়। তারা সেই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। ঘটনার দিন আসামীরা একে অপরের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে পূর্ব থেকে তিশাদের বাসার আশেপাশে ওৎপেতে থাকে, তিশার মা ছেলেকে আনতে যাওয়ার পরেই  তার মায়ের অনুপস্থিতিতে তিশার রুমে প্রবেশ করে তিশাকে একা পেয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে রুমের ভিতরে খাটের উপর শিশু তিশার হাত, মুখ, পা চেপে ধরে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। আসামীদের নির্মম পাষবিকতায় শিশু তিশা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, তখন তারা ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য তিশার গলায় তার মায়ের ওড়না দ্বারা ফাঁস দিয়ে ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে তাকে ঝুলিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। তিশার মা বাড়িতে ফেরার পর তিশাকে ঝুলন্ত অবস্থা হতে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিশা মৃত্যুবরণ করে। 

জিজ্ঞাসাবাদে আসামীরা ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। এই বিষয়ে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
 

news