২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দিনটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এ দিন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এর ফলে তৈরি হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যাত্রাপথ।
২০০৬ সালের শেষ দিকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন, তা নিয়ে শুরু হয় রাজনৈতিক টানাপোড়েন। আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ ছিল তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিরপেক্ষ নয়। এর ফলে দেশে শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। ২২ জানুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে সহিংসতা বাড়তে থাকে। ১১ জানুয়ারি রাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ পদত্যাগ করেন এবং দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন।
পরের দিন অর্থাৎ ১২ জানুয়ারি, দেশের পত্রপত্রিকাগুলো এই ঘটনাকে কীভাবে কভার করেছিল? দেখে নিই দৈনিক প্রথম আলো, ইত্তেফাক, যুগান্তর, সমকাল এবং অন্যান্য পত্রিকায় কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল এই ঘটনা।
দৈনিক প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল, “দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা”। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং সন্ধ্যা থেকে তা কার্যকর হয়। কারফিউ ঘোষণা করা হয় ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির ভাষণকেও গুরুত্ব দিয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, “সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করেই আমি পদত্যাগ করেছি।”
দৈনিক সংবাদ একই দিনে আট কলামজুড়ে প্রধান শিরোনাম করেছিল, “সব উপদেষ্টার পদত্যাগ”। এটির উপ-শিরোনাম ছিল, “২২শে জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল”। প্রতিবেদনটি প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের কারণ এবং সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠনের পথচিত্র তুলে ধরেছিল।
দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ছিল, “সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা”। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, নির্বাচনকালীন সহিংসতার প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সন্ধ্যায় তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকের পর এই সিদ্ধান্ত নেন।
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম দেয়, “Emergency Declared: Iajuddin Quits as Chief Advisor”। তারা আরও উল্লেখ করে, জরুরি অবস্থার সময় সংবাদপত্র এবং মিডিয়ার ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছিল।
সেন্সরশিপ আরোপের খবরটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অনেক পত্রিকা উল্লেখ করেছিল, জরুরি অবস্থার প্রথম রাতেই বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে সংবাদ এবং টকশো প্রচার বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
দৈনিক যুগান্তরের শিরোনাম ছিল, “১৬ বছর পর কারফিউ”। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর এটাই ছিল প্রথমবারের মতো কারফিউ জারি। পত্রিকাটি উল্লেখ করে, ঢাকার রাস্তাগুলোতে ছিল সেনাসদস্যদের টহল এবং মানুষের মধ্যে আতঙ্ক।
এবার একটি দৃষ্টিপাত করা যাক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া নিয়ে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা একতরফা নির্বাচন এবং সেনাসমর্থিত সরকারের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
দৈনিক সমকালে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রেনাটা লক ডেসালিয়েনের মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছিল। তিনি বলেন, “একতরফা নির্বাচন হলে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।”
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামল দুই বছর স্থায়ী হয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কথিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১১ই জানুয়ারির এই ঘটনা একটি গভীর দাগ রেখে গেছে। পত্রপত্রিকা এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা সেই সময়কালীন সংকটকে তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আগামী দিনে এমন সংকট থেকে কীভাবে শিক্ষা নেওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবা উচিত।


