আবারও আলোচনায় এসেছে আফগানিস্তানের বিখ্যাত বাগরাম বিমানঘাঁটি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে জানিয়েছেন, এই সামরিক ঘাঁটি ফের যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনতে চান তিনি। শুধু তাই নয়, ট্রাম্পের বক্তব্য ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে—বাগরাম ফেরত পাওয়ার মূল লক্ষ্য কি সত্যিই চীনকে মোকাবিলা করা, নাকি ইউরেশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার?

বাগরাম নিয়ে ট্রাম্পের জেদ

ট্রাম্প এর আগে নির্বাচনী প্রচারণাতেই দাবি করেছিলেন, বাগরাম নাকি এখন চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) হাতে। দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও তিনি একই দাবি জোর দিয়ে তুলে ধরেন। তাঁর কথায়, আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানোর পরিকল্পনায় আসলে বাগরামকে যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে রাখার বিষয়টিও ছিল।

১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনে সাংবাদিকদের সামনে তিনি সরাসরি বলেন—চীনকে ঠেকাতে বাগরাম ফেরত পাওয়া জরুরি। তালেবানের সম্মতি নিয়েই ঘাঁটিটি নিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। পরে ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প আরও লিখেন, যারা ঘাঁটি বানিয়েছে, সেই আমেরিকার কাছেই তা ফিরতে হবে, নইলে বিপদ আসবেই।

হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প স্পষ্ট করেছেন, আফগানিস্তানের সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং বাগরাম ফেরত পেতে তারা তৎপর।

তালেবানের কঠোর না

তবে ট্রাম্পের এই দাবি সরাসরি উড়িয়ে দিয়েছে তালেবান সরকার। আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিফ অব স্টাফ ফাসিহউদ্দিন ফিতরাত বলেন, “আফগানিস্তানের এক ইঞ্চি মাটিও কাউকে দেওয়া হবে না।”

ইতিহাসে বাগরাম

বাগরাম কাবুল থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সোভিয়েতরা ১৯৫০-এর দশকে এটি নির্মাণ করেছিল। পরে সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে ছিল তাদের প্রধান ঘাঁটি।

২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে প্রবেশ করে এবং তালেবানকে হটিয়ে বাগরামের দখল নেয়। মার্কিন বাহিনী একে বিশাল সামরিক কমপ্লেক্সে রূপ দেয়, যেখানে আধুনিক রানওয়ে, হাসপাতাল, সেনাদের আবাসন, কমান্ড সেন্টার—সবকিছুই ছিল।

২০ বছরের মার্কিন দখলদারির সময় তিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট—বুশ, ওবামা এবং ট্রাম্প নিজেও বাগরাম সফর করেন। ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান ঝড়ের মতো অগ্রসর হলে যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করেই সরে যেতে বাধ্য হয়। এরপর থেকে ঘাঁটি পুরোপুরি তালেবানের নিয়ন্ত্রণে।

বাগরামের কৌশলগত শক্তি

৭৭ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত এই ঘাঁটিতে দুটি রানওয়ে আছে, যার একটি ৩.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। এখানে বি-৫২ বোমারু বিমান থেকে শুরু করে বিশাল কার্গো বিমানও সহজে ওঠানামা করতে পারে। ট্রাম্পের দাবি, এটি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী বিমানঘাঁটি।

বাগরাম শুধু বিমান ওঠানামার জায়গা নয়, এটি ছিল গোটা অঞ্চলে মার্কিন গোয়েন্দা কার্যক্রম, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান এবং কৌশলগত তৎপরতার স্নায়ুকেন্দ্র। এখান থেকে তালেবান, আল-কায়েদা ও আইএসের বিরুদ্ধে হামলা চালানো হতো।

কেন এত গুরুত্ব

চীনের শিনজিয়াং অঞ্চলের পরমাণু স্থাপনাগুলো থেকে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে বাগরাম। এ কারণেই ট্রাম্প বলছেন, চীনকে ঠেকাতে ঘাঁটিটি দরকার। মার্কিন কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন, বাগরামের অবস্থান চীন, রাশিয়া, ভারত ও ইরানের কার্যক্রম নজরদারিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

বাগরাম থেকে পাকিস্তান, ভারত, চীন, রাশিয়া—সবকিছুই হাতের নাগালে। একইসঙ্গে আফগানিস্তানের বিপুল খনিজ সম্পদ ও নতুন বাণিজ্য রুটগুলোর ওপরও যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে।

প্রতীকী মানে

২০২১ সালে তালেবানের উত্থানের মুখে মার্কিন সেনারা যেভাবে হঠাৎ বাগরাম ছেড়ে গিয়েছিল, তা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক প্রকার অপমান। এখন ট্রাম্প আবারও ঘাঁটি ফেরত নিয়ে দেখাতে চান—মধ্য এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখনো পিছু হটছে না।

সব মিলিয়ে, ট্রাম্পের জোরাজুরিতে স্পষ্ট—বাগরাম শুধু একটি ঘাঁটি নয়, এটি হলো ভূরাজনীতির দাবার ছক। আর এর নিয়ন্ত্রণ মানেই ইউরেশিয়ায় কৌশলগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার শক্তিশালী হাতিয়ার।

news