১৭ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ৭৫তম জন্মদিনে ফোন করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি এই আলাপচারিতাকে বর্ণনা করেছিলেন “অদ্ভুত সুন্দর” হিসেবে। এমনকি দুই দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। অনেকেই ভেবেছিলেন, ভারতীয় পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ নিয়ে তৈরি হওয়া উত্তেজনা এবার হয়তো কমবে।
কিন্তু মাত্র তিন দিন পরই পরিস্থিতি উল্টে যায়। ১৯ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে ঘোষণা করলেন—এইচ-১বি ভিসার জন্য বছরে ১ লাখ ডলারের ফি দিতে হবে। আর এই ভিসাধারীদের প্রায় ৭০ শতাংশই ভারতীয় নাগরিক। একই সঙ্গে চাবাহার বন্দরের ইরানি প্রকল্পে ভারতের বিশেষ সুবিধা বাতিল করা হয় এবং ভারতকে “প্রধান মাদক পরিবহন বা অবৈধ মাদক উৎপাদনকারী দেশ”-এর তালিকায় ফেলে দেওয়া হয়।
ভারতের জন্য কূটনৈতিক ধাক্কা
জন্মদিনের শুভেচ্ছার কয়েক দিনের মাথায় এমন কড়া সিদ্ধান্তে হতবাক দিল্লির নীতিনির্ধারকরা। বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী এটিকে সরাসরি মোদির “কূটনৈতিক ব্যর্থতা” বলেছেন।
ট্রাম্প একদিকে ভারতের প্রতি প্রলোভন দেখাচ্ছেন—চীন থেকে আমেরিকার উৎপাদন ভারতে সরিয়ে আনা হবে। অন্যদিকে হঠাৎ করেই ভারতের জিএসপি সুবিধা কেটে দিয়েছেন এবং ইরান থেকে তেল আমদানি কমাতে চাপ দিচ্ছেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—ট্রাম্প কি ইচ্ছাকৃতভাবে মোদিকে আঘাত করছেন, নাকি এটা তাঁর আমেরিকা ফার্স্ট নীতির অংশ, যাতে ভারতকে বাণিজ্যে ছাড় দিতে বাধ্য করা যায়?
“প্রথমে প্রশংসা, তারপর চাপ”
ট্রাম্পের কূটনৈতিক ধরন আসলে অনেকের কাছেই চেনা। আগে প্রশংসা, পরে আচমকা চাপ—এটাই তাঁর স্টাইল। অনেকটা “ভালো পুলিশ, খারাপ পুলিশ”-এর মতো। এতে অপর পক্ষ সবসময় অস্বস্তিতে থাকে এবং খুশি করতে তৎপর হয়।
এমনটা আগেও হয়েছে। ২০১৯ সালের টেক্সাসের “হাউডি মোদি” বা গুজরাটের “নমস্তে ট্রাম্প”—দুই নেতাই তখন একে অপরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। কিন্তু এর পরেই ভারতের জিএসপি সুবিধা কেটে দেওয়া হয় এবং ইরানি তেল আমদানিতে চাপ বাড়ানো হয়।
নতুন করে বড় ধাক্কা
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এই ধারা আবারও দেখা যাচ্ছে। আগস্টের শেষদিকে ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক, তারপর জন্মদিনে উষ্ণ শুভেচ্ছা এবং মাত্র দুই দিন পর তিনটি কড়া সিদ্ধান্ত—এইচ-১বি ভিসার ফি, চাবাহার ছাড় বাতিল এবং মাদক তালিকাভুক্তি।
এইচ-১বি ভিসার এক লাখ ডলারের ফি ভারতের আইটি সেক্টরের জন্য ভয়ংকর ধাক্কা। টিসিএস, ইনফোসিস, উইপ্রোর মতো কোম্পানিগুলোর ব্যয় বেড়ে যাবে, নতুন নিয়োগ কমবে এবং অন্ধ্রপ্রদেশ-তেলেঙ্গানার মতো রাজ্যে রেমিট্যান্স প্রবাহে ঝুঁকি তৈরি হবে।
চাবাহার সুবিধা বাতিল ভারতের জন্য বড় ভূরাজনৈতিক সমস্যা। এই বন্দরে ভারত ইতিমধ্যেই ৫০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। ২০২৪ সালে ইরানের সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তি করেছে, যা আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ দেয় এবং পাকিস্তানকে বাইপাস করার সুযোগ করে দেয়। এখন হঠাৎ মার্কিন ছাড় বাতিল হওয়ায় বিনিয়োগ হুমকির মুখে।
ভারতকে “মাদক পরিবহনকারী দেশ” হিসেবে তালিকাভুক্ত করা দিল্লির ভাবমূর্তিতেও আঘাত হেনেছে। বিশেষ করে যখন মোদি নিজেকে “বিশ্বগুরু” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন।
মূলত চাপ সৃষ্টির কৌশল
এসব সিদ্ধান্ত স্পষ্ট করে দেয়, ট্রাম্প আসলে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন। তিনি চান, ভারত রাশিয়ান তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাক, আমেরিকান পণ্য ও সেবার প্রবেশাধিকার বাড়াক। একই সঙ্গে ভারতের ব্রিকস+ জোটের মাধ্যমে ডলারহীন বাণিজ্যের প্রচেষ্টা ভেস্তে দিতে চাইছেন।
জয়শঙ্করের নীতি ও ভারতের দুর্বলতা
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতির মূল কারণ ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের নীতির ফলেই ভারত ওয়াশিংটনের কৌশলগত জালে জড়িয়ে পড়েছে। চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হলেও, এর বিনিময়ে ভারত কোনো অর্থনৈতিক সুবিধা পায়নি। বরং গালওয়ান সংঘর্ষে চীন ভারতকে মার্কিন ঘনিষ্ঠতার কারণে টার্গেট করেছে।
অন্যদিকে ট্রাম্প ভারতে কারখানা স্থানান্তরের প্রতিশ্রুতি দিলেও, জেনারেল মোটরস, ফোর্ড, হারলে-ডেভিডসনের মতো কোম্পানি দেশ ছেড়ে চলে গেছে।
ভারতের জন্য করণীয়
এখন প্রশ্ন হলো—ভারত কি ট্রাম্পের কূটনৈতিক কৌশলের ফাঁদে আরও জড়িয়ে পড়বে, নাকি নিজস্ব কৌশলগত পথ খুঁজে নেবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের জন্য সময় এসেছে সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার এবং আত্মনির্ভরতার দিকে অগ্রসর হওয়ার।


