কাতারের আমিরের ব্যক্তিগত বোয়িং ৭৪৭ জেটটি এতটাই বিশাল যে, রাজপরিবার যখন দোহার অসহ্য ১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা এড়াতে স্পেনের মায়োর্কায় পৌঁছালেন, তখন চরম ঝামেলায় পড়লেন পালমা বিমানবন্দরের কর্তৃপক্ষ! প্রায় ৪০০ টনের সেই বিমানটি অবতরণের পর রানওয়ের কার্পেটিং (পেভমেন্ট) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা, তা সঙ্গে সঙ্গেই পরীক্ষা করা জরুরি ছিল। এই কারণে তড়িঘড়ি করে রানওয়ে পরিদর্শনের নির্দেশ দিতে হয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে।
বিলাসিতা ও বাস্তবের চাপ
২০২৫ সালের জুনের শেষদিকে যখন আমিরের বোয়িং ৭৪৭–৮ বিবিজে পালমায় নামে, তখন সেটি কেবল একটি বিরল দৃশ্যই ছিল না, এটি এক বিশাল লজিস্টিক চ্যালেঞ্জও তৈরি করে। এই উড়োজাহাজটিকে অনেকেই "উড়ন্ত প্রাসাদ" বলে থাকেন—যা বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল ব্যক্তিগত বিমানের মধ্যে অন্যতম। গ্রীষ্মকালে কাতারের প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে বছরের কিছুটা সময় স্পেনে কাটানো কাতারি রাজপরিবারের একটি রাজকীয় অথচ নিয়মিত ঐতিহ্য। এবারও তারা এই বিশাল বিমান নিয়ে এলেন, আর তখনই ঘটল এই ঘটনা।
প্রতি বছরই, কাতারে যখন তাপমাত্রা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়, তখন রাজপরিবার ভূমধ্যসাগরের মায়োর্কায় চলে যান। সেখানে সাগরের নির্মল বাতাস, ইউরোপীয় খাবার আর দ্বীপ জীবনের নির্ভার আমেজ উপভোগ করেন তাঁরা। তবে এবার আমির তার প্রাসাদে পৌঁছানোর আগেই তার বিমানের অবতরণ নিয়ে শুরু হয় আলোচনা—কারণ এটির বিশাল আকার সাময়িকভাবে পালমা দে মায়োর্কা বিমানবন্দরের নিয়মিত কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল।
মায়োর্কার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম "মায়োর্কাজেইটুং" জানিয়েছে, বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা জনসমক্ষে স্বীকার করেছেন যে, আমিরের বোয়িং ৭৪৭–৮ অবতরণের দিনটি তাদের জন্য "অপারেশনগতভাবে জটিল" ছিল। কারণ, বিশাল আকৃতির এই বিমানের জন্য ব্যবহারযোগ্য ছিল কেবল ০৬এল/২৪আর নামের একটি রানওয়ে—যা পালমার সবচেয়ে লম্বা এবং ভারী বিমানের অবতরণ বা উড্ডয়নের জন্য উপযুক্ত।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, যেসব উড়োজাহাজের ডানার প্রস্থ ও ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি—সেগুলোকে আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (ICAO)-এর "কোড এফ" শ্রেণিভুক্ত করা হয়। কাতারের আমিরের বোয়িং ৭৪৭–৮ এই শ্রেণিভুক্ত। কিন্তু পালমার প্রধান রানওয়ের দৈর্ঘ্য ৩,২৭০ মিটার ও প্রস্থ ৪৫ মিটার—যা এই ধরনের বিমান উড্ডয়ন বা অবতরণের জন্য প্রয়োজনীয় মানের ন্যূনতমটা মাত্র পূরণ করে। তাও আবার কিছু বিশেষ অপারেশনাল শর্ত সাপেক্ষে।
তাই অবতরণের পর কন্ট্রোলাররা একটি কঠোর চেকলিস্ট অনুসরণ করেন—রানওয়ের পেভমেন্টে কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হয়। এই সময় রানওয়ে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়, ফলে অন্যান্য বিমানের টেকঅফ ও ল্যান্ডিং কিছু সময়ের জন্য কমাতে হয়। বিমানের ৬৮.৫ মিটার উইংসপ্যানের (ডানার বিস্তার) কারণে এটির পথের কাছাকাছি ট্যাক্সিওয়েগুলোও ফাঁকা রাখা জরুরি ছিল।
কাতারের আমিরের বিমান পার্কিং অবস্থানে পৌঁছানো পর্যন্ত আশপাশের উড়োজাহাজগুলোকে অপেক্ষা করতে হয়। পালমায় এমন আকারের বিমানের জন্য উপযুক্ত পার্কিং স্পট খুবই সীমিত। তাই ৭৪৭–৮ কে পার্ক করতে হয় বিশেষ টো ও গ্রাউন্ড সার্ভিসের সমন্বয়ের মাধ্যমে। সেই সময়টুকু বিমানবন্দরের অন্যান্য ফ্লাইটের ব্যস্ততা কিছুক্ষণের জন্য হলেও থেমে যায়। এই ঘটনাটিই প্রমাণ করে দেয়, একটি বিশাল বিমান কীভাবে বদলে দিতে পারে বিমানবন্দরের নিয়মিত ছন্দ।
আকাশে রাজকীয় মহিমা
বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রকদের জন্য আরও একটি চ্যালেঞ্জ ছিল—আকাশে এই "হেভি" শ্রেণির উড়োজাহাজের থেকে অন্যান্য ফ্লাইটকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা। বোয়িং ৭৪৭–৮ "হেভি" ক্যাটাগরিতে পড়ে, অর্থাৎ এর পেছনে উড়তে থাকা অন্যান্য বিমানের জন্য কমপক্ষে ৪ থেকে ৬ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব রাখতে হয়। কারণ এটি চলার কারণে পেছনে যে "বিপজ্জনক বায়ুচঞ্চলতা" (Wake Turbulence) তৈরি হয়, সেটা অন্য ফ্লাইটকে প্রভাবিত করতে পারে। এসব প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হলেও—গ্রীষ্মের ব্যস্ত সময়ে এর ফলে ফ্লাইট ব্যবস্থাপনায় কিছুটা বিলম্ব দেখা দেয়, যা পরে পুরো শিডিউলকেই প্রভাবিত করে।
পালমার বিমানবন্দর মূলত মাঝারি আকারের বাণিজ্যিক বিমানের জন্যই তৈরি। তাই যখন কাতারের আমিরের মতো কোনো বিশাল বিমান আসে, তখন চাপটা অনেক বেড়ে যায়। বাধ্য হয়েই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের তখন পুরো কার্যক্রম সংক্ষেপ করতে হয় এবং কিছু রানওয়ে বা অ্যাপ্রোচ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়—যা বিমানবন্দরের কার্যক্ষমতা কিছু সময়ের জন্য কমিয়ে দেয়।
বোয়িং ৭৪৭–৮ বিবিজে: আভিজাত্যের চূড়ান্ত প্রতীক
আমিরের বোয়িং ৭৪৭–৮ বিবিজে'র বাজারমূল্য প্রায় ৩৬০ মিলিয়ন ইউরো—ব্যক্তিগত উড়োজাহাজের বিলাসে এটি সর্বোচ্চ মানের প্রতীক। এর ভেতরে রয়েছে একাধিক লাউঞ্জ, অফিস এবং বৈঠকখানা—যা কাঠ, চামড়া ও সোনার কারুকাজে সাজানো। ৮৯ জন যাত্রী ও ১৪ জন ক্রু বহন করতে সক্ষম এই বিমানটি রাজপরিবারকে নিয়ে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে উড়ে যেতে পারে। উড়োজাহাজটির গায়ে কিছু জানালা বন্ধ করা অংশ দেখা যায়—যা ইঙ্গিত দেয়, এর অভ্যন্তরীণ নকশা প্রচলিত ধরন থেকে অনেক আলাদা এবং রহস্যে মোড়া।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছে, আমিরের ফ্লাইট অবতরণের পুরো প্রক্রিয়া নিরাপত্তা ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে। সাময়িক বিধিনিষেধ ও বিলম্ব ছিল বড় বিমানের ক্ষেত্রে যে প্রোটোকল অনুসরণ করা হয়, তারই অংশ। স্থানীয়দের কাছে অবশ্য কাতারের আমিরের বিমানের আগমন এখন গ্রীষ্মের এক পরিচিত দৃশ্য—যা পর্যটন মৌসুম শুরুর একটি আগমনি সূচক। রাজপরিবারের উপস্থিতি, তাদের বিলাসবহুল ইয়ট আল লুসাইল—ভূমধ্যসাগর তীরে এনে দেয় মধ্যপ্রাচ্যের আভিজাত্যের এক আলাদা আবহ।
কাতারের আমিরের বোয়িং ৭৪৭–৮ কেবল একটি পরিবহন নয়—এটি কাতারি রাজপরিবারের আভিজাত্য, মর্যাদা, পরিশীলতা ও প্রভাবেরও প্রতীক। তাই যখনই এই বিমান কোনো দেশের বিমানবন্দরে নামে, তখন বিমানবন্দরও কিছু সময়ের জন্য তার রাজকীয় উপস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে বাধ্য হয়।
