এ যেন আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির এক পুরোনো দৃশ্যের ভয়ংকর পুনরাবৃত্তি। দক্ষিণ চীন সাগরে আবারও মুখোমুখি আমেরিকা ও চীন, দুটি পরাশক্তি যারা এখন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক দাবার ছকে একে অপরের বিরুদ্ধে ঘুঁটি সাজাচ্ছে। এইবারের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে স্কারবারো শোল—ফিলিপাইনের উপকূল থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরের এক ক্ষুদ্র প্রবালপ্রাচীর। কিন্তু এই অঞ্চলকে ঘিরে এখন জড়ো হয়েছে সামরিক উত্তেজনা, কূটনৈতিক সমীকরণ আর শক্তির প্রদর্শন।

আকাশে রহস্য: রণতরীতে পরপর দুর্ঘটনা
অক্টোবরের ২৬ তারিখে মার্কিন নৌবাহিনীর বিশালাকার বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস নিমিৎজ-এ পরপর দুটি দুর্ঘটনা ঘটে। প্রথমে একটি হেলিকপ্টার দক্ষিণ চীন সাগরে বিধ্বস্ত হয়, এর আধাঘণ্টার মধ্যেই ক্র্যাশ করে একটি এফ-১৮ সুপার হরনেট যুদ্ধবিমান। কী ঘটেছিল, তা নিয়ে মার্কিন সামরিক বাহিনী নীরব থাকলেও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, এর কারণ ছিল “খারাপ জ্বালানি”।

তবে সামরিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিমান দুটি সম্ভবত চীনের মারাত্মক ইলেকট্রনিক জ্যামিং সক্ষমতার শিকার হয়ে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়েছে। তাই মার্কিন কর্তৃপক্ষ এই তথ্য ধামাচাপা দিতে চাইছে।

কারণ যা-ই হোক না কেন, এই ক্ষতি এমন সময় ঘটল যখন দক্ষিণ চীন সাগরে পরিস্থিতি ছিল বহু বছরের মধ্যে সবচেয়ে স্নায়ুচাপপূর্ণ। মার্কিন নৌবহরের এই উপস্থিতি কেবল সামরিক তৎপরতা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক বার্তা—বিশেষ করে বেইজিং ও ম্যানিলার মধ্যে বাড়তে থাকা সংঘাতের প্রেক্ষাপটে।

স্কারবারো শোল: নতুন সংঘাতের পুরনো মঞ্চ
ফিলিপাইনের অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভেতরে থাকা এই প্রবালপ্রাচীরের দখল নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। ২০১২ সালে চীন ফিলিপাইনের জাহাজগুলোকে এলাকা থেকে সরিয়ে দিয়ে কার্যত ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। তখন থেকেই চীনের কোস্টগার্ড ও মাছ ধরার জাহাজ এখানে স্থায়ীভাবে অবস্থান করছে।

২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে চীন দক্ষিণ চীন সাগরের আরও দক্ষিণাঞ্চলে সাতটি সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলে, যার মধ্যে তিনটি ছিল বড় আকারের বিমানঘাঁটি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা স্কারবারো শোলে নতুন ঘাঁটি নির্মাণ করেনি। এর কারণ হলো, ২০১৬ সালে বারাক ওবামা সরাসরি শি জিনপিংকে সতর্ক করেছিলেন—সেখানে নির্মাণ শুরু করা মানে হবে "আমেরিকান রেড লাইন" অতিক্রম করা। সেই সীমারেখা, আপাতত, এখনো টিকে আছে।

চীনের কৌশল ও অপ্রত্যাশিত বিপত্তি
তবে এ বছর পরিস্থিতি বদলেছে। চীন এখন ফিলিপাইনের জাহাজগুলোর উপস্থিতিকে আগের চেয়ে আরও আক্রমণাত্মকভাবে মোকাবিলা করছে। গত ১১ আগস্ট স্কারবারোর কাছে ফিলিপাইনের কোস্টগার্ডকে তাড়া করতে গিয়ে এক চীনা কোস্টগার্ড জাহাজ দুর্ঘটনাক্রমে নিজ দেশের নৌবাহিনীর একটি জাহাজে ধাক্কা মারে। এ ঘটনায় বেইজিং এখনো কোনো প্রাণহানির কথা স্বীকার করেনি, কিন্তু সিএসআইএস-এর তথ্য অনুযায়ী, এতে অন্তত দুই চীনা কোস্টগার্ড সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। এদিকে ঘটনাটির ভিডিও ধারণ করে ফিলিপাইন, যা চীনের জন্য কূটনৈতিকভাবে বেশ বিব্রতকর হয়ে দাঁড়ায়।

এরপর থেকেই ওই এলাকায় উত্তেজনা আরও বেড়েছে। চীনা জাহাজগুলোর আগ্রাসী নৌচালনা নতুন দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করছে, এবং যে কোনো মুহূর্তে প্রাণহানি ঘটতে পারে বলে সতর্ক করেছেন পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা।

আমেরিকার দ্বিধা: মিত্রের পাশে দাঁড়াবে নাকি যুদ্ধের কিনারে?
ফিলিপাইনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা চুক্তি অনুযায়ী, ম্যানিলার বাহিনী আক্রমণের শিকার হলে ওয়াশিংটনের তা রক্ষা করার বাধ্যবাধকতা আছে। ট্রাম্প প্রশাসন বারবার সেই প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—সেই প্রতিশ্রুতি কার্যকর করতে গিয়ে আমেরিকা যদি সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, তবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে।

অক্টোবরজুড়ে দক্ষিণ চীন সাগরে আমেরিকা ও ফিলিপাইন যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়েছে, যেখানে অংশ নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও জাপানের নৌবাহিনীও। ইউএসএস নিমিৎজের উপস্থিতি সেই শক্তিকে আরও জোরদার করেছে। অন্যদিকে, চীনা জাহাজগুলো দূর থেকে এই বহরকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে।

মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল সিবিএস জানিয়েছে, পেন্টাগন স্কারবারোর দিকে হাইমার্স রকেট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা বিবেচনা করছে। যদিও আগেও দক্ষিণ চীন সাগরে এসব রকেট ছোড়া হয়েছে, কিন্তু কখনো এই নির্দিষ্ট এলাকায় লক্ষ্য স্থির করা হয়নি। পেন্টাগন এ খবর অস্বীকারও করেনি—যা নিজেই এক প্রকার সংকেত।

কূটনৈতিক শীতলতার ভেতর ক্ষীণ উষ্ণতা
তবুও সামান্য আশার আলো দেখা যাচ্ছে। ১ নভেম্বর মালয়েশিয়ায় এক নিরাপত্তা সম্মেলনের ফাঁকে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ এবং চীনের নৌবাহিনীপ্রধান অ্যাডমিরাল দং জুনেনর মধ্যে বৈঠক হয়েছে—দুজনের মধ্যে এটি প্রথম সাক্ষাৎ। আশ্চর্যজনকভাবে পরদিন আবার ফোনে কথা বলেন তারা।

ঠিক সেই সময় স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, ইউএসএস নিমিৎজ স্কারবারো শোলের দক্ষিণ-পূর্বে মাত্র ১০০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে।

দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর এই ছায়াযুদ্ধ এখন কেবল সামুদ্রিক নয়—এটি হয়ে উঠছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভবিষ্যৎ শক্তির ভারসাম্যের প্রতীক।

চীন এখনো আমেরিকার "রেড লাইন" অতিক্রম করেনি, আর আমেরিকাও এখনো গুলি ছোড়েনি। কিন্তু উভয়ের নৌবহর যতটা ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরকে ঘিরে ফেলছে, ততটাই প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে— কতটা দূর পর্যন্ত এই নৃত্য চলবে, আর বারুদের স্তূপে আগুন লাগানোর উন্মাদনায় কে প্রথমে এগোবে?

 

news