দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির ইতিহাসে বহু অজানা ও গোপন অধ্যায় ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও রহস্যজনক ঘটনাগুলোর একটি—পাকিস্তানের কাহুটা পরমাণু স্থাপনায় ভারত ও ইসরায়েলের যৌথ হামলার গোপন সামরিক পরিকল্পনা!

সম্প্রতি ইসরাইল ও ভারতের সেই যৌথ পরিকল্পনার চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ–এর সাবেক সদস্য রিচার্ড বার্লো।

প্রায় চার দশক পর সেই রহস্যজনক পরিকল্পনার বিস্তারিত তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এই সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তাঁর ভাষ্যমতে, ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে পাকিস্তানের দ্রুত অগ্রসরমান পারমাণবিক কর্মসূচি রুখতে ভারত ও ইসরায়েল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এক সামরিক অপারেশনের নীলনকশা করেছিল।

কেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল হামলার পরিকল্পনা?
১৯৭৪ সালে ভারতের প্রথম পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার পর পাকিস্তান তাদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগে পড়ে। ড. আব্দুল কাদির খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি দ্রুত এগোতে থাকে। চীন, নেদারল্যান্ডস এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের সহায়তায় ইসলামাবাদ অল্প সময়েই পরমাণু সক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এই অগ্রগতি ভারতের নিরাপত্তা মহলে তীব্র অস্বস্তি তৈরি করে।

অন্যদিকে, ইসরায়েলও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে—কারণ মধ্যপ্রাচ্যের কোনো মুসলিম রাষ্ট্র পরমাণু অস্ত্র পেলে সেটি তেল আবিবের কৌশলগত নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটেই ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে গোপন আলোচনার সূচনা হয়। বার্লোর ভাষ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল তার এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দিয়ে পাকিস্তানের কাহুটা স্থাপনায় ‘প্রিসিশন স্ট্রাইক’ চালাতে আগ্রহী ছিল। ভারত সেই বিমানের জন্য প্রয়োজনীয় রিফুয়েলিং এবং আকাশপথের নিরাপদ করিডোর দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল। পরিকল্পনাটি ছিল দ্রুত, গোপন এবং ধ্বংসাত্মক—একটি সফল হামলা পাকিস্তানের পরমাণু স্বপ্নকে বছরের পর বছর পিছিয়ে দিত।

রিগান কেন থামালেন এই মিশন? যুদ্ধের মুখে দাঁড়িয়েছিল দক্ষিণ এশিয়া
কিন্তু শেষ মুহূর্তে নীরবে এই অপারেশনের পর্দা নামিয়ে যায়। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল: একটি সফল বা ব্যর্থ—দুই ধরনের হামলাই পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধাবস্থার জন্ম দিতে পারত, যার আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মূল্য ছিল বিপুল।

একই সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানও দৃঢ়ভাবে এই হামলার বিরোধিতা করেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল—এমন হামলায় ইসরায়েলের সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ পেলে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার অবস্থান দুর্বল হবে এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত-বিরোধী গোপন অভিযানে জটিলতা তৈরি হতে পারত।

বদলে যেত সামরিক সমীকরণ
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, হামলাটি বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও সামরিক সমীকরণ পুরোপুরি বদলে যেত। পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি হয়তো আরও এক দশক পিছিয়ে যেত এবং ভারত–ইসরায়েল কৌশলগত সম্পর্ক আরও আগেই দৃশ্যমান হয়ে উঠত। সবচেয়ে বড় বিষয়—১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের প্রকাশ্য পারমাণবিক পরীক্ষা আদৌ সম্ভব হত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন থাকত।

রিচার্ড বার্লোর বক্তব্য নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে—আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গোপন সামরিক পরিকল্পনার প্রভাব কতটা গভীর হতে পারে এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কিভাবে একটি যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারে—এ ঘটনাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

 

news