যুদ্ধবিরতি চালু থাকা সত্ত্বেও লেবাননের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় বৃহস্পতিবার নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। প্রায় প্রতিদিনই যুদ্ধবিরতি ভাঙার ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ এই হামলা ঘটল। একই সঙ্গে অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে পরিত্যক্ত কালান্দিয়া বিমানবন্দরের জায়গায় অবৈধ বসতিতে ৯ হাজার নতুন আবাসন ইউনিট নির্মাণের পরিকল্পনাও এগিয়ে নিচ্ছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।
এই আবাসন প্রকল্পের লক্ষ্য হলো পূর্ব জেরুজালেমকে আশপাশের ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং পশ্চিমতীরকে কার্যত দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়া। ইসরায়েলের এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ভবিষ্যতে পূর্ব জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে একটা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বৃহস্পতিবার লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের আল-জাবুর, আল-কাত্রানি ও আল-রাইহান এলাকায় বিমান হামলা চালানো হয়। পাশাপাশি পূর্ব লেবাননের বেকা উপত্যকার বুদাই ও হারমেল অঞ্চলও লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এছাড়া দক্ষিণ লেবাননের দেইর এবং সিরিয়ার শহর ওয়াদি আল-কুসাইর এলাকাতেও পৃথক আরেকটা হামলার খবর পাওয়া গেছে।
ইসরায়েলের দাবি, তারা লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর যোদ্ধা ও অস্ত্রভাণ্ডার লক্ষ্য করেই এসব হামলা চালাচ্ছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে চাপ সৃষ্টির অংশ হিসেবেই এসব সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
তবে হিজবুল্লাহ স্পষ্ট জানিয়েছে, যতদিন ইসরায়েল লেবাননের বিভিন্ন এলাকায় বোমাবর্ষণ করবে এবং দেশটির কিছু অংশ দখল করে রাখবে, ততদিন তারা অস্ত্র ত্যাগ করবে না।
কয়েক সপ্তাহ আগে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠে, যখন ইসরায়েল বৈরুতের দক্ষিণ উপশহরে বিমান হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহর শীর্ষ সামরিক কমান্ডার হাইসম আলী তাবাতাবাইকে হত্যা করে। ওই ঘটনার পর এখনো সামরিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি হিজবুল্লাহ, তবে সংগঠনটি বলেছে—সঠিক সময় এলে তারা জবাব দেবে।
ইসরায়েলের লাগাতার হামলার ঘটনায় জাতিসংঘের পক্ষ থেকে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২০২৪ সালের শেষদিকে যুদ্ধবিরতি চালু হওয়ার পর থেকে লেবাননে অন্তত ১২৭ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে শিশুও রয়েছে। জাতিসংঘ কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, এসব হামলা যুদ্ধাপরাধের শামিল হতে পারে।
এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যেই বহু দশক পর প্রথমবারের মতো যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণকারী একটা কমিটিতে বেসামরিক প্রতিনিধি পাঠিয়েছে লেবানন ও ইসরায়েল। কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিষয়টা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। হিজবুল্লাহর মহাসচিব নাঈম কাসেম ওই আলোচনায় সাবেক রাষ্ট্রদূত সাইমন কারামকে লেবাননের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানোর সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে একে ইসরায়েলের প্রতি বিনা মূল্যের ছাড় বলে আখ্যা দিয়েছেন।
এদিকে লেবাননের সরকারি কর্মকর্তারাও প্রায় প্রতিদিন ইসরায়েলের হামলার ঘটনায় প্রকাশ্যে হতাশা জানিয়েছেন। তাদের মতে, যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করে চলমান এই আক্রমণ দেশটির নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে গুরুতর ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
অন্যদিকে ইসরায়েলি সংগঠন ‘পিস নাউ’ জানিয়েছে, উত্তর-পূর্ব জেরুজালেমের আতরোত এলাকায় বসতি গড়ার এই পরিকল্পনা নিয়ে বুধবার জেলা পরিকল্পনা ও ভবন কমিটির বৈঠকে আলোচনা হবে এবং প্রকল্পের রূপরেখা অনুমোদনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া হবে। সংগঠনটি বলছে, এই পরিকল্পনা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা নস্যাৎ করতে ইসরায়েলের নেওয়া কুখ্যাত ই-ওয়ান পরিকল্পনার কথাই মনে করিয়ে দেয়।
পিস নাউ আরও জানায়, নতুন আবাসন ইউনিটগুলো একটা ঘনবসতিপূর্ণ ফিলিস্তিনি নগরাঞ্চলের ভেতরে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা অধিকৃত পশ্চিমতীরের রামাল্লাহ থেকে শুরু করে উত্তরের কাফর আকাব পর্যন্ত বিস্তৃত।
