পাকিস্তান সুপার লিগ, পিএসএল ২০২৫-এ বাংলাদেশের লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেনের পারফরম্যান্স নিয়ে দেশজুড়ে চলছে উচ্ছ্বাস। তাঁর প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত বোলিংয়ের সুবাদে লাহোর কালান্দার্স পৌঁছে গেছে ফাইনালে। ছয় ম্যাচে ১২ উইকেট নিয়ে রিশাদ প্রমাণ করেছেন, তিনি কেন বিশ্ব ক্রিকেটে উঠতি তারকা। তবে ব্যাটিংয়ে তাঁর প্রত্যাশিত ঝলক দেখা যায়নি। আজকের প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করব রিশাদের বোলিং ও ব্যাটিং পারফরম্যান্স, তাঁর চ্যালেঞ্জ, এবং লাহোরের ফাইনালে যাওয়ার গল্প।

পিএসএল ২০২৫ বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য বিশেষ হয়ে উঠেছে রিশাদ হোসেনের কারণে। ২২ বছর বয়সী এই লেগ স্পিনার লাহোর কালান্দার্সের হয়ে খেলেছেন ছয় ম্যাচ, নিয়েছেন ১২ উইকেট। তাঁর গড় ইকোনমি রেট ৯.১০, যা লেগ স্পিনারের জন্য গ্রহণযোগ্য। রিশাদের বোলিংয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর উইকেট নেওয়ার ক্ষমতা। ইসলামাবাদ ইউনাইটেডের বিপক্ষে শুক্রবারের ম্যাচে তিনি তিন ওভারে ৩৪ রান দিয়ে তিন উইকেট নেন। শাদাব খান, সালমান আগা, এবং জিমি নিশামের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটসম্যানদের আউট করে তিনি লাহোরকে ফাইনালে পৌঁছে দেন। এই পারফরম্যান্স তাঁকে ‘এ’ গ্রেডের দাবিদার করে তুলেছে।

রিশাদের পিএসএল যাত্রা শুরু হয় স্বপ্নের মতো। প্রথম দুই ম্যাচে তিনি প্রতিবার তিনটি করে উইকেট নেন। প্রথম ম্যাচে ৩১ রানে তিন উইকেট, দ্বিতীয় ম্যাচে ২৬ রানে তিন উইকেট। এই ধারাবাহিকতায় একসময় তিনি পিএসএলের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় শীর্ষে ছিলেন। তৃতীয় ম্যাচে মুলতান সুলতানের বিপক্ষে ৪৫ রানে দুই উইকেট নিলেও তাঁর আগ্রাসী বোলিং মনোযোগ আকর্ষণ করে। তবে চতুর্থ ম্যাচে দুই ওভারে ১৮ রান দিয়ে উইকেটবিহীন থাকায় তিনি দল থেকে বাদ পড়েন।

রিশাদের জন্য পিএসএল ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। লাহোর কালান্দার্সের নিয়মিত একাদশে স্থান পাওয়া তাঁর জন্য সহজ ছিল না। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে তিনি সুযোগ পাননি। তবে প্রথম তিন ম্যাচে আট উইকেট নেওয়ার পর তাঁকে দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করা হয়। কিন্তু একটি খারাপ ম্যাচের পর তিন ম্যাচের জন্য বেঞ্চে বসতে হয়। লাহোরে খেলা ম্যাচগুলোতে শাহিন আফ্রিদির দল তাঁকে খেলায়নি। এই সময়টি রিশাদের জন্য মানসিকভাবে কঠিন ছিল। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। ফিরে এসে করাচি কিংসের বিপক্ষে তিন ওভারে ২৮ রান দিয়ে এক উইকেট নেন। এই ম্যাচে তাঁর শেষ ওভারে মাত্র আট রান দেওয়া লাহোরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যদিও দলটি হেরে যায়।

পিএসএলের মাঝে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা এবং আরব আমিরাত সিরিজের কারণে টুর্নামেন্টে বড় বিরতি হয়। এই সময়ে রিশাদ দেশে ফিরে আসেন এবং পিএসএলে ফিরতে সময় লাগে। তবে এলিমিনেটরের আগে দলে যোগ দিয়ে তিনি ইসলামাবাদের বিপক্ষে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর তিন উইকেট লাহোরকে ফাইনালে পৌঁছে দেয়। এই পারফরম্যান্স প্রমাণ করে, রিশাদ চাপের মুহূর্তে দলের জন্য ভরসার নাম।

রিশাদের বোলিংয়ের শক্তি তাঁর বৈচিত্র্য। লেগ স্পিন, গুগলি, এবং ফ্লিপারের মিশ্রণে তিনি ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করেন। ইসলামাবাদের বিপক্ষে তাঁর প্রথম ওভারে শাদাব খানকে আউট করা এবং শেষ ওভারে রান চেপে ধরা তাঁর দক্ষতার প্রমাণ। তবে তাঁর ইকোনমি রেট নিয়ে কিছুটা সমালোচনা রয়েছে। লেগ স্পিনার হিসেবে রান বেশি দেওয়া স্বাভাবিক হলেও, মুলতানের বিপক্ষে ৪৫ রান বা করাচির বিপক্ষে দ্বিতীয় ওভারে ১৩ রান দেওয়া তাঁর উপর চাপ তৈরি করে। তবুও রিশাদ প্রতিবারই উইকেট নিয়ে দলের জন্য অবদান রেখেছেন।

লাহোর কালান্দার্সের পিএসএল ২০২৫-এর যাত্রা ছিল উত্থান-পতনের। নয় ম্যাচে নয় পয়েন্ট নিয়ে তারা পয়েন্টস টেবিলে চতুর্থ স্থানে ছিল। তবে এলিমিনেটরে ইসলামাবাদকে হারিয়ে তারা ফাইনালে পৌঁছে। রিশাদের বোলিং এই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। তাঁর সঙ্গে শাহিন আফ্রিদি, হারিস রউফ, এবং জামান খানের পেস আক্রমণ লাহোরকে শক্তিশালী দল করে তুলেছে। পিএসএল ফাইনালে তারা মুলতান সুলতান বা করাচি কিংসের মুখোমুখি হতে পারে।

যদিও রিশাদের বোলিং নিয়ে প্রশংসার শেষ নেই, তাঁর ব্যাটিং নিয়ে কিছুটা হতাশা রয়েছে। ছয় ম্যাচে তিনি মাত্র ২৩ রান করেছেন, স্ট্রাইক রেট ১০০-এর নিচে। বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ১৩৪.১৮ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করা রিশাদের জন্য এই পারফরম্যান্স বেমানান। করাচির বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে ব্যাটিংয়ে নেমে তিনি এক বলে রান করতে পারেননি। ফাইনালে রিশাদের কাছ থেকে ব্যাট হাতেও অবদান আশা করছেন সমর্থকরা।

রিশাদের পিএসএল যাত্রা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়, এটি বাংলাদেশের ক্রিকেটের সম্ভাবনার প্রতীক। সাকিব আল হাসান এবং মাহমুদউল্লাহর পর তিনি পিএসএলে বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। তাঁর এই পারফরম্যান্স তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য অনুপ্রেরণা। তবে ফাইনালে তাঁর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। মুলতানের মোহাম্মদ রিজওয়ান বা করাচির বাবর আজমের মতো ব্যাটসম্যানদের সামলানো সহজ হবে না।

রিশাদের পিএসএল পারফরম্যান্স তাঁর ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। তিনি প্রমাণ করেছেন, বিদেশি লিগে বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা প্রতিযোগিতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন। তবে তাঁর ব্যাটিংয়ে ধারাবাহিকতা এবং ইকোনমি রেটে উন্নতি প্রয়োজন। লাহোর কালান্দার্সের অধিনায়ক শাহিন আফ্রিদি রিশাদের প্রশংসা করে বলেছেন, তিনি দলের ‘এক্স-ফ্যাক্টর’। ফাইনালে রিশাদের গুগলি আর ফ্লিপার কতটা কার্যকর হয়, তা দেখার জন্য মুখিয়ে আছে ক্রিকেট বিশ্ব।

পিএসএল ২০২৫-এর ফাইনালে লাহোর কালান্দার্সের জয়ের সম্ভাবনা অনেকটাই রিশাদের হাতে। তাঁর বোলিং দলকে শিরোপার কাছে নিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের সমর্থকরাও চাইছেন, রিশাদের হাতে উঠুক পিএসএল ট্রফি। এই তরুণ তারকার পারফরম্যান্স ক্রিকেটের মঞ্চে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে।

দর্শকবৃন্দ, রিশাদ হোসেনের পিএসএল ২০২৫-এর যাত্রা আমাদের গর্বিত করেছে। তাঁর বোলিং দক্ষতা এবং চাপের মুহূর্তে দলের জন্য অবদান রাখার ক্ষমতা তাঁকে বিশ্ব ক্রিকেটের উঠতি তারকা করে তুলেছে। ফাইনালে তাঁর পারফরম্যান্সের দিকে তাকিয়ে আছে গোটা বাংলাদেশ। আশা করি, রিশাদের গুগলি আর লাহোরের আক্রমণ ফাইনালে ইতিহাস গড়বে।

news