ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট আবার হারালো তার এক সোনালি সন্তানকে। ১৯৭৫ সালের প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী দলের নায়ক, ক্যারিবীয় ক্রিকেটের স্টাইলিশ অলরাউন্ডার বার্নার্ড জুলিয়েন আর নেই। ট্রিনিদাদের ভ্যালসাইনে ৭৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
তার প্রস্থান যেন এক যুগের অবসান; সেই সময়ের, যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ শুধু ক্রিকেট খেলত না, ক্রিকেট অধিকার করত। সেই দাপুটে সূচনার গল্পে জুলিয়েন ছিলেন এক অবিচ্ছেদ্য নাম।
১৯৭৫ সালের ঐতিহাসিক বছর:
বিশ্বকাপের প্রথম আসর। কেউ জানত না এই নতুন ফরম্যাটের ক্রিকেট ভবিষ্যতে ইতিহাস গড়বে। কিন্তু জুলিয়েন জানতেন, এটি তার নিজস্ব পরিচয় তুলে ধরার মঞ্চ। বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার সিমার বলকে দু’দিকেই নাচাতে পারতেন, ব্যাটিং সেন্স ছিল অসাধারণ এবং ফিল্ডিংয়ে ছিলেন একদম চঞ্চল।
গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪ উইকেট ২০ রানে। এরপর সেমিফাইনালে নিউ জিল্যান্ডকে ৪ উইকেট ২৭ রানে ভস্ম করে দেন। দুটি ম্যাচই ক্লাইভ লয়েডের দলের ফাইনালে ওঠার ভিত্তি।
লর্ডসে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, জুলিয়েনের ব্যাট থেকে আসে মূল্যবান ২৬ রান, যা দলের চ্যালেঞ্জিং স্কোর গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেই জয় দিয়েই শুরু হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সাম্রাজ্যের উত্থান।
ক্লাইভ লয়েডের আবেগঘন স্মৃতি:
সহযোদ্ধা ও অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড বলেন, “ও সবসময় শতভাগ দিতো, দায়িত্ব থেকে কখনো পিছু হটেনি। ব্যাট হাতে বা বল হাতে আমি সবসময় তার ওপর নির্ভর করতে পারতাম। সে প্রকৃত অর্থেই এক সম্পূর্ণ ক্রিকেটার।”
লয়েড আরও যোগ করেন, “ওর মধ্যে ছিল আনন্দ, ছিল বিনয়। লর্ডসে একবার টেস্ট জেতার পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা দর্শকদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ দিয়েছিলাম। সেই আনন্দে সবার আগে ছিল জুলিয়েন। মানুষ তাকে ভালোবাসতো, সম্মান করতো।”
ক্ষণজীবী কিন্তু উজ্জ্বল ক্যারিয়ার:
জুলিয়েনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার মাত্র চার বছরের—১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭। খেলেছেন ২৪ টেস্ট ও ১২ ওয়ানডে। টেস্টে ৮৬৬ রান ও ৫০ উইকেট; ওয়ানডেতে ৮৬ রান ও ১৮ উইকেট। সংখ্যায় হয়তো বিশাল নয়, কিন্তু প্রভাব ছিল বিশুদ্ধ স্বর্ণের মতো।
তিনি ছিলেন সেই যুগের অংশ, যখন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে ছন্দ, সাহস ও গর্ব এক হয়ে উঠেছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন ছিল বিশ্ব ক্রিকেটের অপ্রতিরোধ্য প্রতীক।
শ্রদ্ধা জানিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড:
ক্রিকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজের সভাপতি কিশোর শ্যালো বলেন, “বার্নার্ড জুলিয়েনকে স্মরণ করা মানে একজন ক্রিকেটারের নয়, এক অধ্যায়ের প্রতিফলনও। তার জীবন প্রমাণ করে, উদ্দেশ্যনিষ্ঠ জীবন কখনো শেষ হয় না।”
তিনি আরও যোগ করেন, “তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও প্রিয়জনদের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা। জুলিয়েন আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবেন।”
উত্তরাধিকারের নাম—বার্নার্ড জুলিয়েন:
জুলিয়েনের গল্প কেবল একজন ক্রিকেটারের নয়, এটি এক জাতির জেগে ওঠার গল্প। তিনি খেলেছেন এমন এক সময়ে, যখন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট শিখছিল নিজের ছন্দে নাচতে। সেই সুরে তিনি ছিলেন প্রথম তালবাদক।
আজ তিনি নেই, কিন্তু তার বল সুইং, ব্যাটের দৃঢ়তা ও মাঠে প্রাণচঞ্চল হাসি সবই রয়ে যাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের স্মৃতির পাতায়।


