হুমায়ুন কবির। ২০১৮ সালের ২৭শে অক্টোবর। পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলায় হাজিরা দিতে ঢাকা থেকে স্টিমার এমভি টার্ন যোগে পিরোজপুর যাচ্ছিলেন। পথে সদরঘাট টার্মিনালের ঢাকা-হুলারহাটগামী স্টিমার থেকে সন্ধ্যা ৬টার দিকে সাদা পোশাকের অস্ত্রধারী ৫ ব্যক্তি তাকে তুলে নেয়। এমন অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গুম ও লোমহর্ষক নির্যাতনের তদন্তের জন্য অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অভিযোগে বলেন, সদরঘাট থেকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে প্রথমে তার দুই হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে ভেজা গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় জিজ্ঞাসা করে- সরকারের বিরুদ্ধে ব্লগার হিসেবে বিভিন্ন ব্লগ ও ফেসবুকে সরকার বিরোধী কেন লেখালেখি করি? বিএনপি’র কোন কোন নেতার নির্দেশে এইসব লেখালেখি করি? প্রধানমন্ত্রী ও সজীব ওয়াজেদ জয়-এর বিরুদ্ধে কেন লিখি? প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ আছে তোকে মেরে ফেলার। একপর্যায়ে তাদেরকে বলতে শুনি যে আমাকে গুম করে নির্যাতন ও মেরে ফেলতে উপর মহলের নির্দেশ আছে।
লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা: হুমায়ুন কবির বলেন, চোখ বাঁধা অবস্থায় সারারাত তাকে বেধড়ক মারধর করে। কানে ইলেক্ট্রিট শক দেয়। সারা রাত শারীরিক নির্যাতন করে। ফজরের আজানের পর অর্ধচেতন অবস্থায় অজ্ঞাত একটা রুমে আটকে রাখে। সেই রুমের ছাদ তার শারীরিক উচ্চতা থেকে কম হওয়ায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না। চোখ বাঁধা এবং দুই হাত পেছনে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে নগ্ন করে প্রতিদিন শারীরিক নির্যাতন নিপীড়ন করেছে। তিনি বলেন, আমার গোপনাঙ্গে ইলেক্ট্রিক শক দিয়েছে। আমার হাঁটু এবং পায়ের গোড়ালিতে বুট পায়ে থেতলিয়ে দিয়েছে। কাঁধে কোমরে ভারী বস্তু দিয়ে পিটিয়েছে। আমার কোমরে এবং পায়ের নখে সুই ফুটিয়েছে, একটা আঙ্গুলের নখ তুলে ফেলেছে। কয়েকদিনই তারা আমাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার কথা বলেছে। একপায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানো অবস্থায় আমার চোখের বাঁধন খুলে যায়। তখন আমি কয়েকজন লোককে দেখতে পাই- মধ্যে স্টিমার থেকে উঠিয়ে আনার সময় যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তাকে চিনতে পারি। তবে আমি কাদের হাতে বন্দি, কোথায় আমার অবস্থান কিছুই জানতাম না। বাথরুম এবং খাবারের সময় একহাতের হ্যান্ডকাফ খুলে দিতো তবে কখনো চোখের বাঁধন খুলত না, গোসল করতে দিতো না। কখন দিন-রাত আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। মাঝে মধ্যে ‘আচ্ছালাতু খাইরুম মিনান্নাউম’ শুনে ফজরের আজান হচ্ছে বুঝতে পেরেছি। এভাবে কতোদিন কেটে গেছে তাও বুঝতে পারিনি।
হঠাৎ একদিন চোখের বাঁধন এবং হ্যান্ডকাফ খুলে দিয়ে গোসল করতে বলে। অনেকদিন পর বাঁধন খুলে দেয়ার পর আমি দীর্ঘ সময় চোখে দেখতে পাইনি। ধীরে ধীরে সবকিছু ঝাঁপসা দেখতে পাই। আমার পরনের শার্ট-প্যান্টে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ, সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন, নাক-মুখ থ্যাতলানো, রক্তাক্ত দেখতে পাই। স্বাভাবিক শব্দ কানে শুনতে পাই না। তখন তাদের কাছে জানতে চাই- আজ কতো তারিখ, কি বার, কয়টা বাজে? ওদের একজন বলে- ৭ তারিখ, সন্ধ্যা ৬টা। একজন এসে আমাকে শেভ করে দেয়। আমার লাগেজ ট্রলি ফিরিয়ে দিয়ে নতুন প্যান্ট-শার্ট পরতে বলা হয় এবং আমার পরনের রক্তাক্ত শার্ট-প্যান্ট ওরা নিয়ে যায়। আমাকে ছেড়ে দেয়া হবে জানায়।
অজ্ঞাত তারিখে আনুমানিক রাত ৮টা নাগাদ তিনজন লোক এসে আমার প্যান্টের দুই পকেটে দু’টি মোবাইল ফোন সেট এবং একটা রুমালে বাধা কিছু টাকা ঢুকিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে অজ্ঞাতস্থানের এক বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখে। তখন একটা বড় কম্পাউন্ডে র্যাব-১০ লেখা অনেকগুলো গাড়ি দেখে দীর্ঘ বন্দিদশায় এই প্রথম বুঝতে পারি- আমি র্যাব-১০ হেফাজতে আছি। ৫ জন সিভিল পোশাক পরিহিত লোক আমাকে একটা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে সায়েদাবাদ পীরের বাড়ি এলাকার ঢাকা-চট্টগ্রাম আন্তঃজেলা বাস কাউন্টারে মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতে বলা হয়। যারা আমাকে নিয়ে এসেছিল- তাদেরই দুইজন আমার দুইপাশে হাঁটছিল। আমি কয়েক কদম হেঁটে যেতেই র্যাব-১০ লেখা একটা পিকআপ, একটা কালো রঙের ল্যান্ড ক্রুজার জীপ এবং অনেক সশস্ত্র ইউনিফর্ম পরা র্যাব সদস্যদের দেখতে পাই। ২০১৮ সালের ২৭শে অক্টোবর সন্ধ্যায় আমাকে তুলে নেয়ার সময় যিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন এবং আমাকে ঝুলিয়ে পেটানোর সময় যাকে দেখেছিলাম সেই অফিসারকে দেখে চিনতে পারি। আমি র্যাব সদস্যদের দেখে ভয় পেয়ে দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করলে আমার পাশে থাকা দুইজন দুইপাশ থেকে আমার পাঁজরে পিস্তল ঠেকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলে- দৌড় দিলেই তোকে গুলি করে দেবো! তখন র্যাবের পোশাক পরিহিত ৪/৫ জন এসে আমাকে জাপটে ধরে টেনে শ্যামলী পরিবহনের বাসের টিকিট কাউন্টারে ঢুকিয়ে আমার পকেট থেকে ফোন আর টাকা বের করে বলে- এই লোক সন্ত্রাসী, অনেক দিন ধরে তাকে ধরার জন্য খুঁজতেছি।
ফোন দেখিয়ে বলে- ‘এই দেখেন, সরকারের বিরুদ্ধে লেখালেখি করার প্রমাণ- একে আমরা গ্রেপ্তার করলাম।’ বলে আমার দুই হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দেয়। তারপর, উপস্থিত লোকজনের সামনে আমার নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে। বাস কাউন্টারের কয়েকজনকে সাক্ষী হিসেবে নাম ঠিকানা লিখে আমাকে র্যাব-১০ লেখা একটা পিকআপ গাড়িতে উঠিয়ে র্যাব-১০ ধলপুর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নেয়ার পর আমাকে র্যাব-১০ এর কোম্পানি কমান্ডার এডিশনাল এসপি মহিউদ্দিন ফারুকী (রুমের সামনে নেম প্লেটে লেখা ছিল) সাহেবের রুমে নিয়ে যায়। মহিউদ্দিন ফারুকী আমাকে বলে- ‘হুমায়ুন কবির, আগে কি হয়েছে সেইসব ভুলে যা, তোকে আজই গ্রেপ্তার করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। তুই ইন্টারনেটে ও ফেসবুকে সরকার বিরোধী লেখালেখি করিস। প্রধানমন্ত্রী ও সজীব ওয়াজেদ জয়-এর বিরুদ্ধে লিখিস। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্যারদের নির্দেশ আছে তোকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার। তোকে ধরার সময় ধস্তাধস্তিতে তোর গায়ে আঘাত লেগেছে। এর বাইরে একটা কথাও বলবি না। আমি র্যাব-২-এ বদলি হয়ে যাচ্ছি। যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলিস তাহলে এবার তোকে র্যাব-২ নিয়ে স্রেফ মেরে ফেলবো।
যে ৪২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের:
হুমায়ুন কবিরের আইনজীবী মাহফুজ হাসান মানবজমিনকে বলেন, গুমের অভিযোগে শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ৪২ জনের নামে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেছি। এরা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়, আসাদুজ্জামান খান কামাল, শাহরিয়ার আলম, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই)-এর সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ সাইফুল আবেদীন, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল টিএম জোবায়ের, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) মহাপরিচালক ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, সাবেক পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া, অতিরিক্ত ডিআইজি ও র্যাব-১০-এর সিও জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর, র্যাব-১০ এর মো. মহিউদ্দিন ফারুকী, সাবেক নায়েব সুবেদার খায়রুল ইসলাম, সাবেক এসআই, মিরপুর মডেল থানার কাজী মো. জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক ওসি, মিরপুর মডেল থানা দাদন ফকির, এসআই আবদুল কাদের , সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার মো. হাবিবুর রহমান, সাবেক এসআই বিল্লাল হোসাইন জনি, সাবেক এএসপি র্যাব-১০ মো. শাহীনুর চৌধুরী ও মো. আবুল কালাম আজাদ, সাবেক এসআই র্যাব-১০ স্বপন কুমার সরকার, আজাহারুল ইসলাম, মো. তোতা মিয়া, মো. আনিছুর রহমান, মো. আনোয়ার হোসেন, মোছা. বিবি শারজাহান, মনোয়ারা আক্তার, মো. শিহাব, এসআই মো. রফিকুল ইসলাম, এসআই শ্রী স্বপন কুমার সরকার, মো. মোমেন খান, এএসআই মো. তানভীর হোসেন, এএসআই মো. কবির হোসেন, মো. নুরুল ইসলাম শেখ, মো. গোলাম আজম, কনস্টেবল মো. জহিরুল ইসলাম, কনস্টেবল মো. মাহমুদ কলি স্বপন, সৈনিক মো. মাহতাব হোসেন, সাবেক ল্যান্স কর্পোরাল আমিনুল ইসলাম, কনস্টেবল মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, কনস্টেবল রিপন চন্দ্র মালো, কনস্টেবল মো. মামুন সরকার, রাজিন ইসলাম।