এটি কোনো গল্প নয়, বাস্তবেই ছিল এমন এক রহস্যময় গ্রাম যেখানে মানুষ হঠাৎ করেই ঢলে পড়ত অদ্ভুত এক ঘুমে। শুধু মানুষ নয়, পশুপাখিও রেহাই পেত না সেই অচেনা ঘুমের কবল থেকে। কাজাখস্তানের কালাচি গ্রাম একসময় সারা বিশ্বে পরিচিত হয়েছিল ‘ঘুমের রাজ্য’ কিংবা ‘মৃত্যুর ঘুমের গ্রাম’ নামে।
গ্রামের যে কেউ, যেকোনো সময়, হঠাৎ করে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতেন। এমনকি অনিদ্রায় ভোগা মানুষরাও এর বাইরে ছিলেন না। কারও ঘুম ভাঙতে সময় লাগত সাত-আট ঘণ্টা, আবার কেউ টানা তিন-চার দিনও ঘুমিয়ে থাকতেন।
কিন্তু ঘুম ভাঙলেই স্বাভাবিক জীবন ফিরত না। আক্রান্তরা মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, অস্বাভাবিক রক্তচাপ বৃদ্ধির মতো সমস্যায় ভুগতেন। শিশুদের মধ্যে হ্যালুসিনেশন দেখা যেত, আর পুরুষদের মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেত যৌন আকাঙ্ক্ষা—যা স্থায়ী হতো সপ্তাহ থেকে মাসব্যাপী।
রহস্যময় ঘুমের সূচনা
২০১০ সালে প্রথমবার এমন ঘটনা নজরে আসে। লিউভক বেলকোভা নামের এক নারী বাজার করতে গিয়ে হঠাৎ অদ্ভুত ঘুমে ঢলে পড়েন। চার দিন পর হাসপাতালে তাঁর জ্ঞান ফেরে। চিকিৎসকেরা প্রথমে ভেবেছিলেন এটি স্ট্রোক, কিন্তু এরপর একে একে শত শত গ্রামবাসী একইভাবে আক্রান্ত হতে থাকেন।
শুধু ২০১০ সালেই প্রায় ১২০ জন গ্রামবাসী এই অচেনা ঘুমের শিকার হন। ২০১৩ সালের পর বিষয়টি বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসে। একবার তো একটি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছিল এবং চার দিন পর একসঙ্গে জেগে ওঠে।
বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান
শুরুর দিকে চিকিৎসকেরা ভেবেছিলেন এটি মানসিক রোগ বা স্নায়বিক সমস্যা। মস্তিষ্ক স্ক্যানেও অতিরিক্ত তরল বা ইডিমার প্রমাণ মিলেছিল। কিন্তু গ্রামবাসীদের ধারণা ছিল কাছাকাছি থাকা ক্রাসনোগরস্কি ইউরেনিয়াম খনি থেকেই নির্গত বিষাক্ত বাতাস এর কারণ।
২০১৫ সালে অবশেষে গবেষণায় বেরিয়ে আসে আসল রহস্য—ওই অঞ্চলের বাতাসে বিপজ্জনক মাত্রায় কার্বন মনোক্সাইড ও হাইড্রোকার্বন ছড়িয়ে পড়েছিল। শরীরে কার্বন মনোক্সাইড বেড়ে গেলে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছায় না, আর তখনই দেখা দেয় সেই ভয়ঙ্কর ‘মৃত্যুর ঘুম’।
আজকের কালাচি
ভয়ংকর সেই ঘুমের আতঙ্কে ধীরে ধীরে গ্রাম ছেড়ে চলে যান মানুষজন। এখন কালাচি পুরোপুরি পরিত্যক্ত—জনমানবশূন্য এক ভুতুরে মৃত্যুপুরি। মানুষের পদচিহ্ন মুছে গেলেও ‘ঘুমের রাজ্য’ কালাচির রহস্য আজও বিজ্ঞানীদের কৌতূহল জাগিয়ে রাখে।


