কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা ইয়াসিন মালিক হঠাৎ করেই ভারতের রাজনীতিতে চাঞ্চল্য তৈরি করেছেন। বর্তমানে নয়াদিল্লির তিহার জেলে যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছেন এই নেতা। তবে সম্প্রতি দিল্লি হাইকোর্টে তিনি যে ৮৪ পৃষ্ঠার হলফনামা জমা দিয়েছেন, তা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে।

মালিকের দাবি, তিনি কেবল সশস্ত্র বিদ্রোহী ছিলেন না, বরং দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ‘গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ’ হিসেবেও কাজ করেছেন।

তিনি জানান, ১৯৯০-এর দশকে যখন কাশ্মীরি তরুণরা বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন থেকেই তিনি ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর দাবি, একাধিক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, গোয়েন্দা প্রধান এমনকি আরএসএস নেতারাও তাঁর সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে তাঁর শ্রীনগরের বাসভবনে গিয়ে আলোচনা করেছেন শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার জন্য।

সবচেয়ে আলোচিত অভিযোগ হলো—২০০৬ সালে হাফিজ সাঈদের সঙ্গে বৈঠক আসলে তাঁর উদ্যোগে হয়নি, বরং ভারতের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা আইবির ব্যবস্থাপনাতেই হয়েছিল, সাঈদকে অস্ত্র ত্যাগে রাজি করানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে।

ইয়াসিন মালিকের কাশ্মীর আন্দোলনের পথচলা শুরু হয় ১৯৮৭ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর, যখন তিনি পাকিস্তানে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরেন এবং জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফোর্স (জেকেএলএফ)-এর নেতৃত্ব নেন। ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী হামলাও চালান তিনি। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাধীন কাশ্মীরের প্রশ্নে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন।

১৯৯০ সালে গ্রেপ্তার হয়ে তিহার জেলে যাওয়ার পর তাঁকে একটি গোপন সমঝোতার আওতায় মুক্তি দেওয়া হয় ১৯৯৪ সালে। তখন তিনি ঘোষণা দেন, তিনি আর সশস্ত্র আন্দোলনে থাকবেন না—বরং মহাত্মা গান্ধীর অনুপ্রেরণায় অহিংস পদ্ধতিতে আন্দোলন চালাবেন। প্রায় ২৫ বছর তিনি অহিংস বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন।

কিন্তু ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর তাঁর জীবনে বড় পরিবর্তন আসে। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, জেকেএলএফ নিষিদ্ধ হয়, এবং পুরোনো মামলাগুলো পুনরায় খোলা হয়—যেমন রুবাইয়া সাঈদ অপহরণ, বিমানবাহিনীর সদস্য হত্যা, পাকিস্তান থেকে অর্থ গ্রহণ ইত্যাদি। এখন এনআইএ আদালতে আবেদন করেছে তাঁর যাবজ্জীবন সাজা মৃত্যুদণ্ডে উন্নীত করার জন্য।

এই পরিস্থিতিতে মালিক হলফনামা দিয়ে দাবি করেছেন, সরকার তাঁর সঙ্গে করা ২৫ বছরের সমঝোতা ভঙ্গ করেছে। তিনি অভিযোগ করেন, অহিংস পথে থাকলে মামলা হবে না—এমন বোঝাপড়ার সম্মান দেখানো হয়নি।

মালিক আরও জানান, ২০১৬ সালে বুরহান ওয়ানি হত্যার পর কাশ্মীর জুড়ে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল, সেটি দমাতে তিনিও ভারত সরকারের হয়ে ভূমিকা রাখেন। এমনকি সৈয়দ আলী শাহ গিলানিকে আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করার অনুরোধও করেছিলেন সরকারের নির্দেশে।

তিনি আরও দাবি করেন, শিল্পপতি ধীরুভাই আম্বানির সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছিলেন ২০০০ সালে, আর ২০০১ সালে বাজপেয়ীর আমলে ভারতীয় পাসপোর্টও পান।

মালিকের এসব দাবির পর মেহবুবা মুফতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখে তাঁকে সহানুভূতির চোখে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আফজাল গুরুর ফাঁসির সঙ্গে মালিকের মামলার তুলনা করে লিখেছেন, ভারত সরকার প্রয়োজনে মানুষকে ব্যবহার করে, পরে বর্জন করে।

যদিও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আজাই সাহনি প্রশ্ন তুলেছেন মালিকের সততা নিয়ে। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের হয়ে কাজ করলেই কেউ সৎ প্রমাণিত হয় না। অন্যদিকে সাংবাদিক বিক্রম জিত সিং মনে করেন, মালিকের দাবিগুলো বিশ্বাসযোগ্য এবং এ ধরনের ব্যাক-চ্যানেল আলোচনার নজির আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে অনেক পুরোনো।

সবমিলিয়ে, ইয়াসিন মালিকের হলফনামা শুধু কাশ্মীর নয়, পুরো ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

 

news