ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের শিল্পনগরী তিরুপ্পুর, যা একসময় “ডলার সিটি” নামে পরিচিত ছিল, এখন নিস্তব্ধ। কারণ—মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ধাক্কায় থমকে গেছে শহরের পোশাক শিল্পের চাকা। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার, কারখানাগুলোর চিমনি থেকে আর ধোঁয়া উঠছে না।

তিরুপ্পুরের পোশাক রপ্তানি কমেছে ২৫ শতাংশ

ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, তিরুপ্পুর সেন্টার অব ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জি শম্পথ বলেছেন, “মোট উৎপাদন অন্তত ২৫ শতাংশ কমে গেছে।”
গত বছর এখান থেকে ৩.৭ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল, যার এক-তৃতীয়াংশই গিয়েছিল ওয়ালমার্ট, টার্গেট ও সিয়ার্স-এর মতো মার্কিন ব্র্যান্ডে।

কিন্তু শুল্ক আরোপের মাত্র সাত সপ্তাহের মধ্যেই শহরের শত শত পোশাক কারখানা অচল হয়ে পড়ে। প্রায় ৬ লাখ শ্রমিকের জীবিকা আজ অনিশ্চিত।

 মনোহর সাহনির গল্প: ৪৫০ ডলার আয় এখন কমে ২৫০

বিহারের দরিদ্র পরিবার থেকে কাজের খোঁজে তিরুপ্পুরে এসেছিলেন মনোহর সাহনি ও তার স্ত্রী। দু’জনে মিলে মাসে ৪৫০ ডলার আয় করতেন—চলছিল সংসার, মেয়ের বিয়ের দেনাও শোধ হচ্ছিল ধীরে ধীরে।
এখন তাদের আয় ২৫০ ডলারেরও নিচে, যা দিয়ে বাড়িভাড়া আর খাবারের খরচই মেটানো কঠিন।

হতাশ সাহনি বলেন,

“অল্প যে টাকাটা আছে, সেটা দিয়ে পরিবারের খাওয়া জোটাব, না মেয়ের দেনা শোধ করব—বুঝতে পারছি না।”

কাজ হারিয়ে তিনি এখন কর্ণাটকে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে দিনে ৪ ডলার আয় করছেন।

 রপ্তানিকারকেরা বলছেন, এখন লক্ষ্য শুধু ‘টিকে থাকা’

তিরুপ্পুরের জিনা গার্মেন্টস-এর অংশীদার মোহন শংকর বলেন,

“লাভ নয়, এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো টিকে থাকা। নগদ প্রবাহ বজায় রাখাই মূল লক্ষ্য।”

তিনি জানিয়েছেন, মার্কিন ক্রেতারা অর্ডার বাতিল বা বিলম্ব করছে, ফলে ৭০ শতাংশ উৎপাদন কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি।

 “ছাড় চাইছে মার্কিন ব্র্যান্ড, কিন্তু টেকা কঠিন”

তিরুপ্পুরের পোশাক মূলত ৫ থেকে ১০ ডলারের টি-শার্ট, লেগিংস ও অন্তর্বাস। অতিরিক্ত খরচ পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই, বললেন কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রির সাবেক চেয়ারম্যান মিল্টন অ্যামব্রোস জন।
তিনি বলেন,

“এখন অনেক ক্রেতা ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় চাইছে। কিন্তু এমন ছাড় টেকসই নয়—৫ শতাংশও নয়।”

 মার্কিন শুল্কে তিরুপ্পুরে ছড়াল অচলাবস্থা

চলতি বছরের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের রপ্তানিপণ্যের ওপর প্রথমে ২৫ শতাংশ, পরে রুশ তেল কেনার কারণে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে।
একদিন পর ভারত সরকার তুলা আমদানিতে শুল্কমুক্তির মেয়াদ বাড়ায়, কিন্তু তিরুপ্পুরের ব্যবসায়ীদের মতে, “এই উদ্যোগ যথেষ্ট নয়।”

 “সরকার আমাদের ভুলে গেছে” — শ্রমিকদের ক্ষোভ

শ্রমিকরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা নেই। জি শম্পথ বলেন, “গ্রাম থেকে আসা শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে, আর যারা আছে তাদেরও কাজের সময় ও বেতন কমছে।”

আরেক শ্রমিক মনোজ কুমার বলেন,

“প্রধানমন্ত্রী বলছেন মাথা নোয়াব না। কিন্তু পেটে খাবার না থাকলে মাথা উঁচু রাখব কীভাবে?”

 ভারতের আশঙ্কা: বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম এগিয়ে যাবে

বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ অজয় শ্রীবাস্তব সতর্ক করেছেন,

“যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ও ভিয়েতনামের ওপর শুল্ক মাত্র ২০ শতাংশ। তাই আমেরিকান ব্র্যান্ডগুলো সহজেই তাদের দিকে অর্ডার সরিয়ে নিতে পারে।”

এই আশঙ্কা এখন তিরুপ্পুরের প্রতিটি পোশাক মালিক ও শ্রমিকের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে।

 

news